‘মিল্কিওয়ে’র মতো দেখতে ১২০০ কোটি বছর পুরনো গ্যালাক্সি খুঁজে পেলেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা
মহাবিশ্বের বয়স যখন মাত্র ১৫০ কোটি বছর, ঠিক সেই সময়ের এক বিশাল গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ খুঁজে পেয়েছেন ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাদের দাবি, এই আবিষ্কার বিগ ব্যাং-এর পর গ্যালাক্সির গঠন নিয়ে বিজ্ঞানীদের এত দিনের ধারণা ও বোঝাপড়া বদলে দিতে পারে।
মহাবিশ্বের বর্তমান বয়স প্রায় ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা এখন যে গ্যালাক্সিটি দেখছেন, সেটি প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি বছর আগের।
সাধারণত বিজ্ঞানীরা ধারণা করে থাকেন, মহাবিশ্বের শুরুর দিকে গঠিত গ্যালাক্সিগুলোর আকার ছিল মূলত অগোছালো এবং বিশৃঙ্খল। কিন্তু ভারতীয় গবেষক রাশি জৈন ও যোগেশ ওয়াদাদেকার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের (জেডব্লিউএসটি) তথ্য বিশ্লেষণ করে যা পেয়েছেন, তা এই ধারণার ঠিক উল্টো।
মহাবিশ্বের সুদূর অতীতে উঁকি দিয়ে তারা দেখেছেন একটি পুরোপুরি গঠিত স্পাইরাল গ্যালাক্সি। দেখতে অনেকটা মহাজাগতিক চরকির মতো, যার গঠন বেশ চমৎকার ও গোছানো।
গত নভেম্বরে ইউরোপের বিখ্যাত জার্নাল 'অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স'-এ তাদের এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে।
অধ্যাপক ওয়াদাদেকার বলেন, 'গ্যালাক্সিটি দেখতে অনেকটাই আমাদের নিজেদের মিল্কিওয়ের মতো। অথচ এটি মহাবিশ্বের বয়স যখন আজকের বয়সের মাত্র ১০ শতাংশ ছিল, তখন গঠিত হয়েছিল।' হিমালয়ের একটি নদীর নামে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা এই গ্যালাক্সির নাম রেখেছেন 'অলকানন্দা'।
পুনের টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের ন্যাশনাল সেন্টার ফর রেডিও অ্যাস্ট্রোফিজিকসের পিএইচডি গবেষক রাশি জৈন চলতি বছরের শুরুর দিকে গ্যালাক্সিটি শনাক্ত করেন।
রাশি জানান, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের পাঠানো ছবি ও তথ্য ঘাঁটতে গিয়ে এই গ্যালাক্সিটি নজরে আসতেই তিনি দারুণ রোমাঞ্চিত হয়ে পড়েন। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও কানাডার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা মিলে ১০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে ২০২১ সালে এই শক্তিশালী টেলিস্কোপটি মহাকাশে পাঠিয়েছিল।
তিনি বলেন, 'আমি প্রায় ৭০ হাজার মহাজাগতিক বস্তুর খুঁটিনাটি তথ্য বিশ্লেষণ করছিলাম। এর মধ্যে মাত্র একটিই ছিল এমন বিশাল ও সুগঠিত স্পাইরাল গ্যালাক্সি। এর ব্যাস প্রায় ৩০ হাজার আলোকবর্ষ।'
'আমরা সেখানে নক্ষত্রপুঞ্জগুলোকে সুতোর মধ্যে গাঁথা পুতির মালার মতো নকশায় সাজানো দেখেছি। বর্তমানে আমাদের আশপাশের স্পাইরাল গ্যালাক্সিগুলোতে ঠিক যেমনটা দেখা যায়, এই গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলো সেভাবেই ছিল,' বলেন তিনি।
রাশি যখন তার সুপারভাইজার অধ্যাপক ওয়াদাদেকারকে বিষয়টি জানান, শুরুতে তিনি তা বিশ্বাসই করতে চাননি। তিনি বলেন, 'বিগ ব্যাং এর মাত্র দেড় শ কোটি বছর পর এত বিশাল একটি স্পাইরাল গ্যালাক্সির অস্তিত্ব থাকাটা সত্যিই বিস্ময়কর।'
অধ্যাপক ওয়াদাদেকার বলেন, 'মাত্র কয়েক কোটি বছরের মধ্যে এই গ্যালাক্সি ১ হাজার কোটি সূর্যের ভরের সমান নক্ষত্র জড়ো করে ফেলেছে। মহাজাগতিক মানদণ্ড বিবেচনায়, এই গঠনপ্রক্রিয়া অকল্পনীয়ভাবে দ্রুতগতিতে হয়েছে।'
নাসার হিসাবে, মহাবিশ্বে আনুমানিক ১০ হাজার কোটি গ্যালাক্সি রয়েছে। বিগ ব্যাং এর কয়েক মিলিয়ন বছরের মধ্যেই এর অনেকগুলো গঠিত হতে শুরু করেছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দীর্ঘকাল ধরে মনে করতেন, 'কসমিক ডন' এর সেই সময়টা ছিল খুব বিশৃঙ্খল। আর সে সময়ের গ্যালাক্সিগুলো ছিল ছোট ও কম ভরের।
কিন্তু অধ্যাপক ওয়াদাদেকার বলছেন, 'এই গ্যালাক্সিটি একেবারেই আলাদা। বিশাল, আমাদের মিল্কিওয়ের এক-তৃতীয়াংশ এবং এতে প্রায় ১ হাজার কোটি নক্ষত্র রয়েছে।' তিনি আরও জানান, বর্তমানে মিল্কি ওয়েতে যে হারে নতুন তারার জন্ম হয়, এই গ্যালাক্সিতে তারার জন্মের হার তার চেয়ে অন্তত ২০ থেকে ৩০ গুণ বেশি।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ কাজ শুরুর পর থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত নতুন ও দূরের গ্যালাক্সি খুঁজে পাচ্ছেন। শুরুর দিকে নাসার প্রকাশ করা ছবিতে অনেক গ্যালাক্সিকেই মনে হতো লালচে ছোপ বা অস্পষ্ট দাগের মতো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জেমস ওয়েব আরও জটিল সব কাঠামো খুঁজে পাচ্ছে।
এখন কী অবস্থায় আছে 'অলকানন্দা'?
নতুন এই গ্যালাক্সি সম্পর্কে পাওয়া তথ্যগুলো ১২০০ কোটি বছর আগের। কারণ, সেখান থেকে আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে এই দীর্ঘ সময় লেগেছে।
রাশি বলেন, 'আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় বলেই আমরা অতীতে উঁকি দিতে পারি। একটি গ্যালাক্সির জীবনকাল এত বিশাল যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখা সম্ভব নয়। তাই আমরা পরিসংখ্যানগত গবেষণা করি।'
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, বর্তমানে গ্যালাক্সিটির কী অবস্থা? এটি কি আদৌ আছে? থাকলে কোন অবস্থায় আছে?
এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ওয়াদাদেকার বেশ মজার উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'লোকে যখন জিজ্ঞেস করে বর্তমানে গ্যালাক্সিটি কোথায় আছে, আমি তাদের বলি—সেটা জানতে হলে আরও ১২০০ কোটি বছর অপেক্ষা করতে হবে!'
আপাতত গবেষকরা জেমস ওয়েব বা চিলির আলমা মানমন্দির ব্যবহার করে আরও বিস্তারিত পর্যবেক্ষণের পরিকল্পনা করছেন। তাদের লক্ষ্য, নতুন আবিষ্কৃত এই গ্যালাক্সিটি কীভাবে তার স্পাইরাল বাহুগুলো তৈরি করল, তা বোঝা।
