তেজাস বিধ্বস্তে ম্লান হলো ভারতের যুদ্ধবিমান রপ্তানির স্বপ্ন
দুবাই এয়ার শোতে প্রদর্শনীর মহড়ার সময় ভারতের তৈরি একটি তেজাস যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। ঘটনায় নিহত হন পাইলট। আন্তর্জাতিক অস্ত্র ক্রেতাদের সামনে তেজাস বিধ্বস্ত হওয়ার এই ঘটনা দেশটির গর্বের এই প্রকল্পে বড়সড় আঘাত হেনেছে বলা চলে। এই দুর্ঘটনার ফলে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নিদর্শন হিসেবে পরিচিত এই জেটের ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অর্ডারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
শুক্রবারের এই দুর্ঘটনার কারণ তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। তবে ঘটনাটি এমন এক সপ্তাহে ঘটল যখন প্রদর্শনীতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের লড়াই চলছিল। মাত্র ছয় মাস আগেই প্রতিবেশী এই দুই বৈরী দেশ দশকের বৃহত্তম আকাশযুদ্ধে মুখোমুখি হয়েছিল।
চার দশকের দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর তেজাস জেটকে দেশের বাইরেও প্রতিষ্ঠিত করার যে উদ্যোগ ভারত নিয়েছিল, এই জনসমক্ষে ঘটা দুর্ঘটনা তা ম্লান করে দেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই দুর্ঘটনায় উইং কমান্ডার নামাংশ সয়াল নিহত হয়েছেন, যার প্রতি ভারত শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মিচেল ইনস্টিটিউট ফর অ্যারোস্পেস স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ডগলাস এ বার্কি বলেন, 'এর দৃশ্যপট খুবই নির্মম।' তিনি এয়ারশোতে দুর্ঘটনার ইতিহাসের প্রসঙ্গ টেনে এ কথা বলেন, যেখানে বিভিন্ন দেশ ও শিল্প তাদের বড় জাতীয় অর্জনগুলো তুলে ধরতে চায়।
তিনি আরও বলেন, 'একটি বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত সংকেত দেয়: একটি নাটকীয় ব্যর্থতা।' তবে তিনি এও যোগ করেন যে, তেজাস নেতিবাচক প্রচারের শিকার হলেও এটি সম্ভবত আবার গতি ফিরে পাবে।
প্যারিস এবং ব্রিটেনের ফার্নবোরোর পর দুবাই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এয়ারশো। এ ধরনের ইভেন্টে দুর্ঘটনা এখন বেশ বিরল। ১৯৯৯ সালে প্যারিস এয়ারশোতে কসরত দেখানোর সময় রাশিয়ার সুখোই সু-৩০ মাটিতে স্পর্শ করে বিধ্বস্ত হয়েছিল। এর এক দশক আগে একই ইভেন্টে একটি সোভিয়েত মিগ-২৯ বিধ্বস্ত হয়। তবে উভয় ঘটনায় ক্রুরা নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন এবং ভারত পরবর্তীকালে উভয় জেটেরই অর্ডার দিয়েছিল।
বার্কি বলেন, 'যুদ্ধবিমান বিক্রি উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক বাস্তবতার দ্বারা পরিচালিত হয়, যা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে ছাপিয়ে যায়।'
রপ্তানি সম্ভাবনা ও অভ্যন্তরীণ সংকট
আশির দশকে সোভিয়েত আমলের পুরোনো মিগ-২১ এর বিকল্প হিসেবে তেজাস কর্মসূচি শুরু হয়েছিল। হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেডের (হ্যাল) তেজাস সরবরাহে ধীরগতির কারণে মিগ-২১ এর অবসরে বারবার সময় বাড়ানো হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত গত সেপ্টেম্বরে এটি অবসরে যায়।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি হ্যালের কাছে অভ্যন্তরীণভাবে ১৮০টি উন্নত এমকে-১এ ভেরিয়েন্টের অর্ডার রয়েছে। কিন্তু জিই অ্যারোস্পেসের ইঞ্জিন সরবরাহ চেইন সমস্যার কারণে এখনো সরবরাহ শুরু করা যায়নি।
হ্যালের একজন সাবেক নির্বাহী, যিনি সম্প্রতি কোম্পানি ছেড়েছেন, বলেছেন যে দুবাইয়ের এই দুর্ঘটনা 'আপাতত রপ্তানির সম্ভাবনা নাকচ করে দিচ্ছে'। এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বাজারের দিকে লক্ষ্য ছিল তেজাসের। এছাড়া হ্যাল ২০২৩ সালে মালয়েশিয়ায় একটি অফিসও চালু করেছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই সাবেক নির্বাহী বলেন, 'আগামী বছর তেজাসের উৎপাদন বাড়ানোর দিকে মনোযোগ থাকবে, তবে তা ভারতের অভ্যন্তরে ব্যবহারের জন্য।'
তবে ভারতীয় বিমানবাহিনী (আইএএফ) তাদের যুদ্ধবিমান স্কোয়াড্রন কমে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত। অনুমোদিত ৪২টির স্থলে বর্তমানে স্কোয়াড্রন সংখ্যা নেমে এসেছে ২৯-এ। এর মধ্যে মিগ-২৯ এর শুরুর দিকের ভেরিয়েন্ট, অ্যাংলো-ফ্রেঞ্চ জাগুয়ার এবং ফরাসি মিরাজ ২০০০ আগামী বছরগুলোতে অবসরে যাওয়ার কথা রয়েছে।
আইএএফ-এর একজন কর্মকর্তা বলেন, 'তেজাস তাদের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এটি উৎপাদনজনিত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।'
বিকল্প হিসেবে তাৎক্ষণিক ঘাটতি পূরণে ভারত রেডিমেড বা 'অফ-দ্য-শেলফ' কেনাকাটার কথা বিবেচনা করছে। ভারতের দুজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এর মধ্যে আরও ফরাসি রাফাল কেনার অপশন রয়েছে। তারা আরও জানান, বর্তমানে সার্ভিসে থাকা প্রায় ৪০টি তেজাসের সঙ্গে আরও যুক্ত করার পরিকল্পনা এখনো ভারতের রয়েছে।
এছাড়া ভারত ৫ম প্রজন্মের এফ-৩৫ এবং সু-৫৭ যুদ্ধবিমানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রতিযোগিতামূলক প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করছে। এই দুটি উন্নত মডেলও চলতি সপ্তাহে দুবাইয়ে এয়ার শোতে একসাথে দেখা যাবে।
ভবিষ্যৎ কর্মসূচির ভিত্তি
ভারত বছরের পর বছর ধরে বিশ্বের অন্যতম বড় অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। তবে ২০২৩ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তেজাস যুদ্ধবিমানে চড়ে এটিকে আত্মনির্ভরশীলতার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন।
অধিকাংশ যুদ্ধবিমান কর্মসূচির মতো তেজাসকেও প্রযুক্তি এবং কূটনীতির সংযোগস্থলে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য লড়াই করতে হয়েছে। লন্ডনের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের অ্যাসোসিয়েট ফেলো ওয়াল্টার ল্যাডউিগ বলেন, ভারতের ১৯৯৮ সালের পারমাণবিক পরীক্ষার পর নিষেধাজ্ঞা এবং স্থানীয় ইঞ্জিন তৈরিতে সমস্যার কারণে প্রাথমিকভাবে এর উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।
তবে তিনি বলেন, এই জেটের দীর্ঘমেয়াদি তাৎপর্য 'বিদেশে বিক্রির চেয়ে ভারতের ভবিষ্যৎ কমব্যাট-এয়ারক্রাফট কর্মসূচির জন্য এটি যে শিল্প ও প্রযুক্তিগত ভিত্তি তৈরি করছে, তার ওপরই বেশি নির্ভর করবে।'
আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিত্র
প্রদর্শনীতে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই সদলবলে উপস্থিত ছিল। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানি দলের উপস্থিতিতে তেজাস একাধিক আকাশ কসরত প্রদর্শন করে। পাকিস্তান তাদের জেএফ-১৭ থান্ডার ব্লক ৩ যুদ্ধবিমান সরবরাহের জন্য একটি 'বন্ধুপ্রতীম দেশের' সঙ্গে সাময়িক চুক্তি স্বাক্ষরের কথা প্রকাশ করেছে। এই বিমানটি চীনের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করা হয়েছে।
র্যাম্পে থাকা একটি জেএফ-১৭ এর পাশে পিএল-১৫ইসহ বিভিন্ন অস্ত্র সাজানো ছিল। এটি চীনা ক্ষেপণাস্ত্র পরিবারের রপ্তানি ভেরিয়েন্ট। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, মে মাসে পাকিস্তানের সঙ্গে আকাশযুদ্ধে ভারতের ব্যবহৃত অন্তত একটি ফরাসি রাফাল এই ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতেই ভূপাতিত হয়েছিল।
একটি প্রদর্শনী স্টলে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পিএসি জেএফ-১৭ এর ব্রোশিওর বা প্রচারপত্র বিতরণ করছিল। সেখানে এই বিমানকে 'ব্যাটল-টেস্টেড' বা যুদ্ধে পরীক্ষিত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। চার দিনের সংঘাতে পাকিস্তান যে দুটি মডেল মোতায়েন করেছিল, এটি তার একটি।
অন্যদিকে ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তেজাসের বিষয়ে ভারত অনেক বেশি সতর্ক। মে মাসে চার দিনের সংঘাতে এটি সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করা হয়নি। তবে এর কোনো কারণ তারা জানাননি। এছাড়া চলতি বছর নয়াদিল্লিতে ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের আকাশ প্রদর্শনীতেও এটি অংশ নেয়নি। কর্মকর্তারা এর কারণ হিসেবে এক ইঞ্জিনের বিমানের নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেছিলেন।
