১০ রুপিরও কম পেনশন, ‘ঐতিহ্য কোটি টাকার’; আজও নিতে ছুটে আসেন ভারতীয় রাজবংশধররা

ভারতের উত্তর প্রদেশের হুসেইনাবাদে উনিশ শতকে তৈরি পিকচার গ্যালারির দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যান ৯০ বছর বয়সী ফৈয়াজ আলী খান। শহরটির রাজকীয় অতীতের সাক্ষী এই ভবন। বয়সের ভারে হাত কাঁপলেও চোখেমুখে অদ্ভুত এক দীপ্তি। তিনি এসেছেন তাঁর 'ওয়াসিকা' বা রাজকীয় পেনশন সংগ্রহ করতে।
'ওয়াসিকা' শব্দটি ফারসি, যার অর্থ লিখিত চুক্তি। এটি মূলত সাবেক অযোধ্যা রাজ্যের নবাবদের বংশধর এবং সহযোগীদের জন্য মঞ্জুর করা একটি পেনশন।
১৮৫৬ সালে ব্রিটিশরা অযোধ্যা দখল করে নেওয়ার আগ পর্যন্ত নবাবরাই ছিলেন এই অঞ্চলের শাসক। ভারতে এখন আর রাজতন্ত্র নেই, নেই কোনো রাজকীয় সুযোগ-সুবিধাও। তবে রাজ্য ও রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে গেলেও উত্তর প্রদেশ, কেরালা ও রাজস্থানের মতো কয়েকটি রাজ্যে এই পরিবারগুলোর জন্য কিছু পেনশন ব্যবস্থা এখনো টিকে আছে।
অযোধ্যার সাবেক শাসক মোহাম্মদ আলী শাহের আমলে তৈরি পিকচার গ্যালারির বাইরে দাঁড়িয়ে ফৈয়াজ আলী খান জানান, ১৩ মাস পর তিনি তাঁর পাওনা বুঝে নিতে এসেছেন। তিনি বলেন, 'দাদা-পরদাদার আমল থেকে আমরা এই ওয়াসিকা পেয়ে আসছি। পেনশনের অঙ্কটা এতটাই সামান্য যে টাকাটা নিতে বছরে মাত্র একবারই আসি।'

পেনশনের পরিমাণও যৎসামান্য—মাসে মাত্র নয় রুপি ৭০ পয়সা। কিন্তু তার পরিবারের কাছে এই টাকার চেয়েও বড় হলো সম্মান; একসময়ের সমৃদ্ধ অতীতের সঙ্গে টিকে থাকা এটাই শেষ যোগসূত্র। তার ছেলে শিকোহ আজাদের ভাষায়, 'যদি এক পয়সাও পাই, আমরা হাজার রুপি খরচ করে এসে তা নিয়ে যাব।'
বর্তমানে 'ওয়াসিকাদার' হিসেবে পরিচিত প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ এই পেনশন পেয়ে থাকেন। তবে এই পেনশনের পরিমাণ নির্দিষ্ট নয় এবং প্রজন্মের সঙ্গে সঙ্গে তা কমতে থাকে। যেমন, কোনো ব্যক্তি যদি ১০০ রুপি পেতেন, তার মৃত্যুর পর দুই সন্তানের মধ্যে তা ভাগ হয়ে প্রত্যেকে ৫০ রুপি করে পাবেন।
লখনউয়ের ইতিহাসবিদ রোশান তাকি জানান, ওয়াসিকা বিতরণের শুরু ১৮১৭ সালে। অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলার স্ত্রী বহু বেগম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দুই কিস্তিতে ৪০ মিলিয়ন রুপি এই শর্তে ঋণ দিয়েছিলেন যে, তার আত্মীয় ও সহযোগীরা ঋণের সুদ থেকে মাসিক পেনশন পাবেন।
এই ঋণগুলো ছিল চিরস্থায়ী, যার অর্থ মূল অর্থ কোম্পানিকে আর কখনো ফেরত দিতে হতো না। পরে আফগান যুদ্ধের অর্থায়নের জন্য ব্রিটিশরা আরও কয়েকজন নবাবকে ঋণ দিতে বাধ্য করেছিল।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর বহু বেগমের দেওয়া ঋণের একটি অংশ ব্যাংকে জমা রাখা হয়। উত্তর প্রদেশের ওয়াসিকা কর্মকর্তা এসপি তিওয়ারির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে একটি স্থানীয় ব্যাংকে জমা থাকা প্রায় ২৬ লাখ রুপির সুদ থেকেই এই পেনশন দেওয়া হয়।
সমালোচকদের মতে, এই ভাতাগুলো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার ধ্বংসাবশেষ এবং আধুনিক যুগে এর কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকা উচিত নয়। তবে সুবিধাভোগীরা এটিকে দেখেন ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতির সম্মান হিসেবে।

আইনজীবী শহীদ আলী খান নিজেও এই পেনশন পান। তার দাদা ছিলেন নবাব মোহাম্মদ আলী শাহের মন্ত্রী। তিনি বলেন, 'টাকা দিয়ে এই ওয়াসিকার পরিমাপ করা যায় না। এটাই আমাদের পরিচয়, যা কোটি টাকার চেয়েও দামী।' তিনি জানান, প্রতিবছর মহররম মাসের ঠিক আগে তিনি এই টাকা তোলেন এবং শুধুমাত্র ধর্মীয় কাজেই তা ব্যয় করেন।
তবে অনেকেই পেনশনের পরিমাণ বাড়ানোর পক্ষে। ফৈয়াজ আলী খান বলেন, 'নবাবদের আমল থেকে আমরা ৪ শতাংশ সুদে ওয়াসিকা পাচ্ছি, অথচ এখনকার ব্যাংকের সুদের হার এর চেয়ে অনেক বেশি।' তার ছেলে যোগ করেন, 'এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, মাত্র নয় রুপি ৭০ পয়সা নেওয়ার জন্য আমাকে ৫০০ রুপির পেট্রোল পুড়িয়ে আসতে হয়।'
বিশেষজ্ঞরা জানান, মূলত এক তোলার (প্রায় ১১.৭ গ্রাম) বেশি ওজনের রুপার মুদ্রায় এই ওয়াসিকা পরিশোধ করা হতো। কিন্তু ভারতীয় মুদ্রায় অর্থ প্রদান শুরু হওয়ায় এর প্রকৃত মূল্য এক ধাক্কায় অনেকটা কমে যায়।
পেনশনের পরিমাণ সংশোধনের দাবিতে আদালতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন শহীদ আলী খান। তিনি বলেন, 'আমরা আদালতে প্রশ্ন তুলব, কেন ওয়াসিকা এখন আর রুপার মুদ্রায় দেওয়া হয় না। আর যদি রুপায় না-ই দেওয়া হয়, তবে অন্তত আজকের রুপার মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধ করা উচিত।'
শুধু ওয়াসিকার আর্থিক মূল্যই নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একে ঘিরে থাকা জৌলুসও হারিয়ে গেছে। মাসুদ আবদুল্লাহর পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই পেনশন পেয়ে আসছে। তিনি স্মরণ করেন, একসময় পেনশন সংগ্রহ করাটা ছিল উৎসবের মতো। বলেন, 'মানুষজন ঘোড়ার গাড়ি ও টমটমে চড়ে আসত। নারীরা পর্দাঘেরা পালকিতে করে আসতেন। সেই প্রথা এখন আর নেই।'
ফৈয়াজ আলী খানও তার বাবার মুখে শুনেছেন, ওয়াসিকা সংগ্রহ করাটা ছিল রীতিমতো এক মেলার মতো। 'সেখানে ফেরীওয়ালা বসত, খাবারের দোকানপাট থাকত আর পিকচার গ্যালারিতে জড়ো হতেন শত শত পেনশনভোগী,' বলেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে যোগ করেন, 'সেই পরিবেশটা আর এখন নেই।'