আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, শান্তি প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি: আলাস্কার বৈঠকে যা চান পুতিন ও ট্রাম্প

শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যে আয়োজিত শীর্ষ বৈঠকে ভিন্ন ভিন্ন অগ্রাধিকার নিয়ে বসবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। খবর বিবিসি'র।
বৈঠকে মূলত রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান নিয়ে আলোচনা হবে। পুতিন ইউক্রেনের ভূখণ্ড দখলের বিষয়ে শুরু থেকেই অনড় অবস্থানে রয়েছেন। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রকাশ্যেই বলেছেন, তিনি বিশ্ব শান্তির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখতে চান।
তবে বৈঠকে দুই নেতার নজর অন্য দিকেও থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পুতিনের জন্য এটি হতে পারে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের সুযোগ। আর ট্রাম্পের লক্ষ্য অনুমান করা তুলনামূলক কঠিন, কারণ সাম্প্রতিক সময়ে রুশ নেতাকে নিয়ে তিনি নানামুখী ও পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করেছেন।
পুতিন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চান… এবং আরও অনেক কিছু
এই শীর্ষ বৈঠক থেকে পুতিনের প্রথম অর্জন ইতোমধ্যেই নিশ্চিত—আর তা হলো স্বীকৃতি।
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এ স্বীকৃতি পাওয়া মানে, ক্রেমলিনকে একঘরে করার পশ্চিমা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বৈঠকটির আয়োজনই তার প্রমাণ। ক্রেমলিন যেমন ঘোষণা করেছে, বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনও হবে। এতে ক্রেমলিন যুক্তি দেখাতে পারবে, রাশিয়া আবারও বিশ্ব রাজনীতির শীর্ষ টেবিলে ফিরে এসেছে।
সপ্তাহের শুরুতে রুশ ট্যাবলয়েড মস্কোভস্কি কমসোমোলেটস উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে লিখেছে, 'একঘরে করার চেষ্টার ফল তো ভালোই হলো।'
পুতিন শুধু যুক্তরাষ্ট্র–রাশিয়া শীর্ষ বৈঠকের ব্যবস্থা করেননি, এর জন্য একটি বিশেষ স্থানও বেছে নিয়েছেন। আলাস্কা ক্রেমলিনকে নানা সুবিধা দেবে।
প্রথমত, নিরাপত্তা। আলাস্কার মূল ভূখণ্ড রাশিয়ার চুকোটকা অঞ্চল থেকে সবচেয়ে কাছের বিন্দুতে মাত্র ৯০ কিলোমিটার (৫৫ মাইল) দূরে। ফলে পুতিন 'বিরোধী' দেশগুলোর আকাশপথ এড়িয়ে সেখানে পৌঁছাতে পারবেন।
দ্বিতীয়ত, ভৌগোলিক অবস্থান। এটি ইউক্রেন ও ইউরোপ থেকে অনেক দূরে। কিয়েভ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের পাশ কাটিয়ে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার ক্রেমলিনের পরিকল্পনার সঙ্গে এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এর রয়েছে ঐতিহাসিক প্রতীকী গুরুত্বও। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জারশাসিত রাশিয়া আলাস্কা বিক্রি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। একবিংশ শতাব্দীতে মস্কো সেই ঘটনার উদাহরণ টেনে শক্তি প্রয়োগে সীমান্ত পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
মস্কোভস্কি কমসোমোলেটস লিখেছে, 'আলাস্কা একটি স্পষ্ট উদাহরণ যে রাষ্ট্রীয় সীমানা বদলাতে পারে এবং বড় অঞ্চলগুলোর মালিকানা পরিবর্তন হতে পারে।'
তবে পুতিনের লক্ষ্য শুধু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও প্রতীকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি চান বিজয়। তার জোর দাবি, ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল—দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝিয়া ও খেরসন থেকে দখল করা সব ভূমি রাশিয়ার কাছে থাকবে। পাশাপাশি, কিয়েভকে ওই অঞ্চলগুলোর যে অংশ এখনো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে আছে, সেখান থেকেও সরে যেতে হবে।
ইউক্রেনের কাছে এটি গ্রহণযোগ্য নয়। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সাফ জানিয়েছেন, 'ইউক্রেনীয়রা তাদের ভূমি দখলদারদের হাতে তুলে দেবে না।'
ক্রেমলিনও তা জানে। তবে যদি ভূখণ্ডগত দাবির বিষয়ে তারা ট্রাম্পের সমর্থন নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে হিসাবটা এমন হতে পারে যে, ইউক্রেন অস্বীকার করলে ট্রাম্প কিয়েভের প্রতি সব সমর্থন বন্ধ করে দেবেন। আর সে অবস্থায় রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে।
তবে আরেকটি সম্ভাবনাও আছে। রাশিয়ার অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। বাজেট ঘাটতি বাড়ছে, তেল ও গ্যাস রপ্তানি থেকে আয় কমছে। যদি অর্থনৈতিক সংকট পুতিনকে যুদ্ধ শেষ করতে চাপ দেয়, তাহলে ক্রেমলিন সমঝোতার পথে হাঁটতে পারে।
তবে আপাতত তেমন কোনো ইঙ্গিত নেই, কারণ রুশ কর্মকর্তারা বারবার বলছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়াই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
ট্রাম্প শান্তি প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি দেখানোর সুযোগ খুঁজছেন
২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় ডোনাল্ড ট্রাম্প জোর দিয়ে বলেছিলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করা তার জন্য খুব সহজ হবে—কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি তা করতে পারবেন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ফের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সেই প্রতিশ্রুতি তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। যুদ্ধ থামানোর প্রয়াসে তিনি কখনও ইউক্রেন, কখনও রাশিয়ার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে এক নাটকীয় বৈঠকে ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে তিরস্কার করেন। পরে সাময়িকভাবে ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহায়তা ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় স্থগিত করেন।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অনমনীয় অবস্থান ও বেসামরিক এলাকায় হামলার সমালোচনা আরও জোরালো করেছেন। রাশিয়া ও তাদের সঙ্গে ব্যবসা করা দেশগুলোর ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য একের পর এক সময়সীমা বেঁধে দেন তিনি। গত শুক্রবার ছিল সর্বশেষ সময়সীমা, কিন্তু আগের মতো এবারও শেষ মুহূর্তে তিনি পিছু হটেন।
এখন পুতিনকে যুক্তরাষ্ট্রে আতিথেয়তা দিচ্ছেন ট্রাম্প এবং 'ভূমি-বিনিময়' নিয়ে আলোচনা করছেন। ইউক্রেনের শঙ্কা, এর অর্থ হতে পারে শান্তির বিনিময়ে ভূমি ছেড়ে দেওয়া।
ফলে শুক্রবার পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে ট্রাম্প আসলে কী চাইছেন, তা তার পরিবর্তনশীল বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের কারণে স্পষ্ট নয়।
এই সপ্তাহে বৈঠক ঘিরে প্রত্যাশা কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন তিনি—সম্ভবত যুদ্ধে জড়িত দুই পক্ষের মধ্যে কেবল একজন উপস্থিত থাকায় বড় ধরনের অগ্রগতির সম্ভাবনা সীমিত, এই উপলব্ধি থেকেই।
সোমবার ট্রাম্প বলেন, শীর্ষ বৈঠক হবে এক ধরনের 'পরিস্থিতি বোঝার' আলোচনা। রুশ নেতার সঙ্গে সমঝোতার সম্ভাবনা তিনি 'সম্ভবত প্রথম দুই মিনিটেই' বুঝে ফেলবেন বলেও মন্তব্য করেন।
তার ভাষায়, 'আমি হয়তো উঠে গিয়ে বলব—শুভকামনা, এখানেই শেষ। হয়তো বলব, এটা সমাধান হওয়ার নয়।'
মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিটও এই বক্তব্যকে সমর্থন করে বৈঠককে বলেন এক ধরনের 'শোনার অধিবেশন'। তবে সপ্তাহের মাঝামাঝি এসে ট্রাম্প আবারও আশাবাদী সুরে কথা বলেন। তার দাবি, জেলেনস্কি ও পুতিন দুজনেই শান্তি চান।
ট্রাম্পকে নিয়ে প্রায়ই বলা হয়—তার কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত কিছু আশা করাই ভালো। বুধবার জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতারা তার সঙ্গে কথা বলেন, যেন তিনি পুতিনের সঙ্গে এমন কোনো সমঝোতায় না পৌঁছান যা ইউক্রেন মেনে নেবে না বা নিতে পারবে না।
এ বছর প্রায় সারাবছরই একটি বিষয় স্পষ্ট ছিল—যুদ্ধ শেষ করার সুযোগকে স্বাগত জানাবেন ট্রাম্প। শপথ গ্রহণের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, তার সবচেয়ে গর্বের উত্তরাধিকার হবে 'শান্তির দূত' হিসেবে পরিচিত হওয়া। নোবেল শান্তি পুরস্কারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও তার গোপন নয়।
বৃহস্পতিবার ওভাল অফিসে ট্রাম্প দপ্তরের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিশ্বজুড়ে তিনি যেসব সংঘাত সমাধান করেছেন বলে মনে করেন, সেসবের সাফল্যের কথা তুলে ধরেন। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে প্রশ্নে তিনি বিরলভাবে স্বীকার করেন, এটি তার জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ।
তার ভাষায়, 'আমি ভেবেছিলাম সবচেয়ে সহজ হবে এটা। আসলে এটা-ই সবচেয়ে কঠিন।'
ট্রাম্প সাধারণত খুঁটিনাটি নিয়ে সময় নষ্ট করেন না। তবে আলাস্কার অ্যাঙ্কোরেজে বৈঠকে শান্তির পথে কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবি করার সুযোগ পেলে, তিনি তা কাজে লাগাবেন।
পুতিনও দক্ষ আলোচক। রাশিয়ার শর্তে হলেও, ট্রাম্পকে এমন দাবি করার সুযোগ তিনি হয়তো করে দিতে পারেন।