ড্রোন শো কি আতশবাজির বিকল্প হয়ে উঠছে?

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষ। নববধূর হাত ধরে হাঁটছেন ববি আন্ডারউড। ঠিক তখনই তাদের জন্য ছিল একটি চমক। আকাশের দিকে তাকাতেই ববি ও তার স্ত্রীর চোখ ছানাবড়া।
"হঠাৎ করেই ড্রোনগুলো উঠতে শুরু করল," বলেন নববধূ সিওভন আন্ডারউড। "সে এক আবেগময় ও অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা।"
রাতের আকাশে একসঙ্গে উঠল প্রায় ৩০০টি ড্রোন। বিভিন্ন রঙের আলোয় তারা তৈরি করল এমন কিছু চিত্র, যা নবদম্পতির জীবনের সঙ্গে জড়িত। যেমন বেসবল খেলার দৃশ্য—কারণ ববি একজন বড় বেসবল ভক্ত। আবার দেখা গেল একটি হীরার আংটি, আঙুলে পড়ানো হচ্ছে।
২০২৪ সালের নিউ ইয়ার্স ইভে, যুক্তরাষ্ট্রর নিউ ইয়র্কে বিয়ে করেন এই দম্পতি। ওয়েডিং প্ল্যানারের সহায়তায় আয়োজন করা হয় এই ড্রোন শোটি ।
"আমরা যেন হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম, এই মুহূর্তটা কি বাস্তব?'" বলেন সিওভন।
শুধু বিয়েতেই নয় ড্রোন শো এখন জন্মদিন, কনসার্ট, এমনকি বড় বড় ক্রীড়া ইভেন্টেও দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কিছু কিছু থিম পার্কে তো প্রতিদিনই নিয়মিত ড্রোন শো হয়।
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী , ২০২৪ সালে গ্লাস্টনবেরি মিউজিক ফেস্টিভ্যালে প্রথমবারের মতো ড্রোন শো হয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি 'সেলেস্টিয়াল' এই শো পরিচালনা করে। আর গত অক্টোবরেই চীনে হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ড্রোন শো যেখানে ১০,২০০টি ড্রোন একসাথে উড়ে গড়ে তোলে চোখধাঁধানো আলোর প্রদর্শনী।
এত কিছুর পর প্রশ্ন উঠতেই পারে তবে কি আতশবাজির দিন শেষ?
"ড্রোন শো সত্যিই একধরনের শিল্প," বলেন যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন ইন্ডাস্ট্রি বিশ্লেষক স্যালি ফ্রেঞ্চ, যিনি 'দ্য ড্রোন গার্ল' নামেই বেশি পরিচিত। তিনি জানান, এখন ড্রোন শো দেখা যাচ্ছে বেসবল ম্যাচ, কর্পোরেট সম্মেলন, এমনকি সমুদ্রবন্দরের ক্রুজ লঞ্চ অনুষ্ঠানেও।
তিনি আরও বলেন, এখনকার ড্রোন শোগুলো অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর ও দক্ষতাসম্পন্ন। হাজার হাজার ড্রোন একসঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করে সৃষ্টি করে জীবন্ত চিত্র কিংবা চলমান প্যাটার্ন।

"আমি একটি স্টার ওয়ারস থিমের ড্রোন শো দেখেছি, যেখানে পুরো লাইটসাবার যুদ্ধ পর্যন্ত দেখানো হয়েছিল," যোগ করেন ফ্রেঞ্চ।
তবে একটি বড় বাধা এখনো রয়েছে আর তা হলো এর মূল্য। যুক্তরাজ্যে প্রতিটি ড্রোন পরিচালনার খরচ প্রায় ৩০০ ডলার। সেক্ষেত্রে ৫০০ ড্রোনের একটি শো করতে খরচ হতে পারে দেড় লাখ ডলারের বেশি।
সিওভন আন্ডারউড জানেন না সঠিক অঙ্ক, তবে আন্দাজ করেন তাদের বিয়ের ড্রোন শোতে খরচ হয়েছে কয়েক হাজার ডলার।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ড্রোন শো প্রতিষ্ঠান স্কাইম্যাজিক বিশ্বজুড়ে বড় পরিসরের শো করে চলেছে। সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর প্যাট্রিক ও'মাহোনি জানান, তাদের কিছু শো-এর বাজেট ১০ লাখ মার্কিন ডলারেরও বেশি।
স্কাইম্যাজিকের শো হয়েছে নানা দেশে, যেমন ২০২৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার কোচেল্লা মিউজিক ফেস্টিভ্যালে। যুক্তরাজ্যেও তাদের ড্রোন শো দেখা গেছে রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক উপলক্ষে বিবিসি সম্প্রচারিত কনসার্টে।

আগে আতশবাজির সাথে কাজ করা ও'মাহোনি বলেন, ড্রোন প্রযুক্তি আউটডোর ইভেন্টকে আমূল বদলে দিয়েছে। স্কাইম্যাজিকের রয়েছে ৬ হাজার কাস্টম ড্রোন। প্রতি ড্রোন উড়তে পারে ঘণ্টায় ৩৬ কিমি বেগে, থাকে এলইডি লাইট ও ২৫ মিনিটের ব্যাটারি লাইফ।
ভ্রমণে সুবিধার জন্য ড্রোনগুলো থাকে ফ্লাইট কেসে। ভেন্যুতে বড় তাঁবুর নিচে সেগুলো খুলে আধা মিটার ব্যবধানে সাজিয়ে রাখা হয় গ্রিড প্যাটার্নে। এরপর একটি কমান্ড দিলে, হাজার হাজার ড্রোন একসাথে চালনা হয় একজন মাত্র পাইলটের হাত থেকে।
জিপিএস-ভিত্তিক জিও-ফেন্সিং প্রযুক্তি ড্রোনগুলোকে নির্ধারিত সীমানার বাইরে যেতে দেয় না। বাতাস বেশি হলে ড্রোন নিজেরাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত জায়গায় ফিরে আসে।
তবে আতশবাজির 'বুম' শব্দ বা আবেগপূর্ণ অভিঘাত এখনো ড্রোনে পাওয়া যায় না, বলেন ড্রোন বিশেষজ্ঞ স্যালি ফ্রেঞ্চ। তবে প্রযুক্তির অগ্রগতিতে কিছু ড্রোন এখন আগুনের ঝরাও ছেড়ে দিতে পারে, বলে জানান বাজার বিশ্লেষক বিল রে। তবে খরচ এখনো অনেক বেশি। কারণ, শো শুরুর আগে ড্রোন সাজানো এবং পরে গুটিয়ে নেওয়া সবই এখনো ধীরগতির ও হাতেই করা হয়।
ড্রোন শো ডিজাইন করে এমন প্রতিষ্ঠান ড্রোন শো অ্যানিমেশনস-এর প্রধান নির্বাহী পেদ্রো রোসারিও বলেন, একেক দেশে একেক নিয়ম হওয়ায়, আন্তর্জাতিক শো করতে অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। যেমন, ইংল্যান্ডের নিয়ম মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় অনেক কঠোর।
তবে সীমাবদ্ধতার মধ্যেও রয়েছে সৃজনশীলতার বিশাল ক্ষেত্র। "ড্রোন, আতশবাজি, লেজার একসঙ্গে ব্যবহার করে এমন কিছু তৈরি করা যায়, যা মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যায়, একটি গল্প বলা যায়," বলেন রোসারিও।
আর ববি ও সিওভন আন্ডারউডের বিয়েতে তা-ই ঘটেছে। অতিথিরাও মুগ্ধ। "অনেকে আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে প্রশংসা করেছেন, কিন্তু সবাই যেটা বিশেষভাবে বলেছেন তা হলো ড্রোন শো। এমন কিছু তারা আগে কখনো দেখেননি," বলেন তিনি।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা