লস অ্যাঞ্জেলেসে অভিবাসনবিরোধী অভিযান: বিক্ষোভকারীদের এলাকা ছাড়তে বলল পুলিশ

অভিবাসনবিরোধী অভিযানের জেরে বিক্ষোভে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেস শহর। রোববার এ অভিযানের বিরুদ্ধে তৃতীয় দিনের মতো রাস্তায় নেমেছেন হাজারো বিক্ষোভকারী। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে মোতায়েন করা ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
বিক্ষোভের জেরে পুলিশ লস অ্যাঞ্জেলেসের কেন্দ্রস্থলকে সমাবেশের জন্য 'অবৈধ' ঘোষণা করেছে। বিক্ষোভকারীদের এ এলাকা ছাড়তে বলেছে পুলিশ।
বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও ফ্ল্যাশ গ্রেনেড ছুড়েছেন।
বিক্ষোভরতরা শহরের গুরুত্বপূর্ণ ১০১ ফ্রি ওয়ে-তে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করলে নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে অভিযান চালায়।
লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ জানিয়েছে, ডাউনটাউন এলাকায় একটি সেলফ-ড্রাইভিং গাড়িতে আগুন দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।
অনেকগুলো দলে বিভক্ত হয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে সমবেত হন বিক্ষোভকারীরা। মার্কিন অভিবাসন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে অনেকের হাতে মেক্সিকান পতাকা দেখা গেছে।

এদিকে লস অ্যাঞ্জেলেসে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনের পক্ষে যুক্তি গিয়ে ট্রাম্প বলেছেন, এই ইউনিট 'আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করবে'।
তবে ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসম ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনকে 'অবৈধ' উল্লেখ করে এ ইউনিটকে প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যান্য ডেমোক্র্যাট গভর্নররাও এভাবে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনকে 'ক্ষমতার উদ্বেগজনক অপব্যবহার' বলে নিন্দা জানান।
নিউসম হোয়াইট হাউজকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করেছেন, যেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
প্রায় ৩০০ ক্যালিফোর্নিয়া ন্যাশনাল গার্ড সদস্য কাজ করছেন লস অ্যাঞ্জেলসে। এছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ার টুয়েন্টিনাইন পামস কমব্যাট সেন্টার-এর কর্তব্যরত ৫০০ মেরিন 'প্রস্তুত' রয়েছেন বলে জানিয়েছে ইউএস নর্দার্ন কমান্ড।

এদিকে 'অবৈধ' সমাবেশের পর লস অ্যাঞ্জেলেসজুড়ে বহু বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রাজ্য গভর্নর ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিসসহ একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তি বিক্ষোভকারীদের সমর্থন জানান।
সিএনএনের ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, অন্তত দুটি সেলফ-ড্রাইভিং গাড়ি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে।
রোববার দুপুর নাগাদ শত শত মানুষ জড়ো হয় লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের কেন্দ্রস্থলের মেট্রোপলিটন ডিটেনশন সেন্টারের বাইরে, যেখানে আগে চালানো অভিবাসন অভিযানে ধৃতদের আটক রাখা হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।
একপর্যায়ে কিছু বিক্ষোভকারী গার্ড সদস্যদের একেবারে কাছে চলে গেলে আরেকদল ইউনিফর্মধারী কর্মকর্তা এসে ধোঁয়াভর্তি ক্যানিস্টার ছুড়ে দেন রাস্তায়।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ ডিপার্টমেন্ট বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ভিড় নিয়ন্ত্রণকারী অস্ত্রের গুলি ছোড়ে। এরপর বিক্ষোভকারীদের বড় একটি দল ১০১ ফ্রিওয়ে অবরোধ করে। বিকালের দিকে ক্যালিফোর্নিয়া হাইওয়ে প্যাট্রল কর্মকর্তারা তাদের সরিয়ে দেন।
গভর্নর গ্যাভিন নিউসম রোববার বিকেলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে পাঠানো এক চিঠিতে বলেন, ন্যাশনাল গার্ডের উপস্থিতি শহরের উত্তেজনা আরও 'উসকে দিচ্ছে'।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন জরুরি ছিল, কারণ নিউসম ও অন্যান্য ডেমোক্র্যাটরা অভিবাসন এজেন্টদের লক্ষ্য করে হওয়া সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
গত কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম গভর্নরের অনুরোধ ছাড়াই কোনো রাজ্যে ন্যাশনাল গার্ড পাঠানো হয়েছে।
সর্বশেষ গভর্নরের অনুমতি ছাড়াই ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। ওই বছর আলাবামায় একটি নাগরিক অধিকার মিছিল রক্ষা করতে সেনা পাঠিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন।

শুক্রবার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের কেন্দ্রস্থলে শুরু হওয়া বিক্ষোভ টানা দুই দিন চলার পর ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়। পরদিন শনিবার বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণাঞ্চলের ল্যাটিনো অধ্যুষিত শহর প্যারামাউন্ট ও পাশের কম্পটনেও।
শনিবার প্যারামাউন্টে একটি হোম ডিপোর কাছে ফেডারেল এজেন্টরা সাময়িক ঘাঁটি তৈরির সময় বিক্ষোভকারীরা বর্ডার পেট্রোলের গাড়িগুলো আটকানোর চেষ্টা করেন। কেউ কেউ পাথর ও সিমেন্টের টুকরো ছুড়ে মারেন। এর জবাবে দাঙ্গা দমনকারী পোশাকে থাকা এজেন্টরা টিয়ার গ্যাস, ফ্ল্যাশ ব্যাং ও পিপার বল নিক্ষেপ করেন।
বৃহস্পতিবার অভিবাসন দপ্তরের পরিচালিত টানা ধরপাকড়ের পর উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। সেদিনেই শহরে ১০০-র বেশি অভিবাসী গ্রেপ্তার হন। প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন একজন প্রভাবশালী শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা।
রাজনৈতিক বিভাজন ও অভিবাসন যুদ্ধ
ডেমোক্র্যাট-শাসিত লস অ্যাঞ্জেলেস বহু মানুষ হিস্পানিক ও বিদেশে জন্মগ্রহণকারী। এ শহরে রিপাবলিকান ট্রাম্প প্রশাসনের এই তৎপরতা রাজনৈতিক বিভাজনকে আরও উসকে দিচ্ছে।
ভারমন্টের ডেমোক্রেটিক সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে আখ্যা দেন 'দেশকে দ্রুত স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্টের নমুনা' হিসেবে।
সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস—যিনি লস অ্যাঞ্জেলেসেই থাকেন—বলেন, অভিবাসীদের এভাবে গ্রেপ্তার ও ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন 'একটি নির্মম, ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনা; যার লক্ষ্য আতঙ্ক ছড়িয়ে বিভক্তি তৈরি করা'।
কমালা বলেন, যারা 'আমাদের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য দাঁড়িয়েছেন', তিনি তাদের পাশে আছেন।
অন্যদিকে, হাউস স্পিকার ও ট্রাম্পঘনিষ্ঠ মাইক জনসন প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, 'গ্যাভিন নিউসম প্রমাণ করেছেন, তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন না বা নিতে চান না—তাই প্রেসিডেন্টকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।'
এর আগে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, 'বিদেশি পতাকা বহনকারী বিদ্রোহীরা অভিবাসন কর্মকর্তাদের আক্রমণ করছে, আর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অর্ধেক বলছে—সীমান্ত নিয়ন্ত্রণই সমস্যা।'
হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা ও অভিবাসন ইস্যুতে কড়াকড়ির প্রবক্তা স্টিফেন মিলারও এসব বিক্ষোভকে 'সহিংস বিদ্রোহ' বলে উল্লেখ করেছেন।
অভিবাসন অভিযানের প্রেক্ষাপট
শুক্রবার রাতের প্রথম দফা বিক্ষোভ শুরু হয় আইসিই-র (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট) অভিযানের পর, যেখানে অন্তত ৪৪ জনকে অভিবাসন আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে আটক করা হয়।
ডিপার্টমেন্ট অভ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (ডিএইচএস) দাবি করেছে, শুক্রবারের বিক্ষোভে 'প্রায় ১ হাজার দাঙ্গাবাজ' অংশ নেয়।
অভিবাসীদের অধিকার সংগঠন সিএইচআইআরএলএর নির্বাহী পরিচালক অ্যাঞ্জেলিকা সালাস বলেন, শুক্রবার আটক হওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে আইনজীবীরা দেখা করতে পারেননি, যা 'গভীর উদ্বেগজনক'।
সালাস বলেন, অভিযান চালানো হয়েছে হোম ডিপোর আশেপাশে। সেখান থেকে পথচারী শ্রমিক ও হকারদের আটক করা হয়েছে। পাশাপাশি একটি পোশাক কারখানা ও একটি গুদাম থেকেও লোকজন গ্রেপ্তার হয়েছে।