জৈব বর্জ্যকে সারে রূপান্তরিত করছে খাদক ছোট্ট পোকা

ছোট্ট এই পোকাটি নিজের ওজনের চারগুণ জৈব বর্জ্য খেতে পারে এবং এগুলোকে পরিবেশবান্ধব সারে পরিণত করতে পারে। খবর বিবিসির
জৈব পদার্থ খাওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে ছোট্ট কিন্তু শক্তিশালী পোকা 'ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই লার্ভা' (বিএসএফএল) এর। জৈব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও অনুর্বর মাটির গুণগত মান পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে পোকাটি। এই পোকা খাদ্যবর্জ্যকে পুষ্টিসমৃদ্ধ জৈব সার 'ফ্রাস'-এ রূপান্তরিত করে।
অনেক আগে থেকেই কৃষিতে পোকা-মাকড়কে খাদ্য উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এখন কৃষকেরা পোকার বিষ্ঠা (যাকে ফ্রাস বলা হয়) টেকসই সার হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখছেন।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ৩৩ শতাংশের বেশি মাটি অনুর্বর হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে ফ্রাস মাটির জীববৈচিত্র্য ও গুণমান পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
২০২৪ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) তিনটি প্রকল্পে অনুদান দেয়। এই প্রকল্পগুলোতে এই বিশেষ পোকার সামর্থ্যকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে।
এর মধ্যে অন্যতম হলো 'চ্যাপুল ফার্মস'। এটি ওরেগনের একটি প্রকল্প উন্নয়ন সংস্থা, যারা আমেরিকার কৃষিতে পোকামাকড়ের ব্যবহার ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে খাদ্যবর্জ্য হ্রাস, মাটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার এবং উচ্চমানের পশুখাদ্য উৎপাদনে কাজ করছে।
ফার্টিলাইজার প্রোডাকশন অ্যান্ড এক্সপ্যানশন প্রোগ্রাম-এর সমর্থনে এই উদ্যোগটির মাধ্যমে কৃষিতে পোকার ব্যবহার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও গুণগত মানসম্পন্ন সার উৎপাদনের জন্য ক্রমশ গুরুত্ব পাচ্ছে।
এত ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও, কৃষিতে বিএসএফএল-এর ব্যাপক ব্যবহার এখনও সীমিত। বিএসএফএল প্রায় সব ধরনের জৈব বর্জ্য খেতে পারে। যেমন, খাদ্যবর্জ্য থেকে শুরু করে কৃষি উপকরণের অবশিষ্টাংশ পর্যন্ত।
চ্যাপুল ফার্মসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলি তার অত্যধিক খিদে ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য প্রক্রিয়া করতে সক্ষম। একটি লার্ভা তার নিজের ওজনের চারগুণ পর্যন্ত জৈব বর্জ্য খেতে পারে! সাধারণ কম্পোস্টিং-এ ১০ মাস পর্যন্ত সময় লাগে। সে তুলনায় লার্ভাগুলো মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে পুষ্টিসমৃদ্ধ ফ্রাস উৎপাদন করতে পারে।

মিসিসিপি স্টেট ইউনিভার্সিটির প্ল্যান্ট অ্যান্ড সয়েল সায়েন্সেস বিভাগের সহকারী গবেষক শংকর গণপতি শানমুগাম বলেন, 'এরা খুব দ্রুত প্রজননও করতে পারে এবং মৃত ও পচনশীল পদার্থ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে টিকে থাকে, যার মানে হলো এটি বর্জ্যে বেঁচে থাকতে পারে।'
শানমুগাম বিএসএফএল-এর ফ্রাসকে কৃষি পুষ্টি উপাদান হিসেবে ব্যবহারের ওপর গবেষণা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এটি নিয়ে গবেষণা এখনও বেশ নতুন হলেও, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে।
চ্যাপুল ফার্মস স্থানীয় কৃষকদের কাছে বর্জ্যের বিনিময়ে ফ্রাস সরবরাহ করে। এতে কৃষকরা পুষ্টিসমৃদ্ধ সার পায় এবং চ্যাপুল ফার্মস তাদের কার্যক্রম চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় জৈব পদার্থ সংগ্রহ করতে পারে।
এটি শুধুমাত্র কৃষির জন্যই উপকারী নয়, বরং এটি পোকামাকড়ের সংখ্যা বৃদ্ধিতেও সহায়তা করছে। কারণ পোকা চাষ কেন্দ্রগুলো পোকামাকড় বেঁচে থাকার জন্য জন্য একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ তৈরি করে। এই লার্ভা থেকে উৎপাদিত ফ্রাস উদ্ভিদের জন্য অপরিহার্য পুষ্টি সরবরাহ করে এবং মাটির জীববৈচিত্র্য বাড়িয়ে দেশীয় উদ্ভিদ ও পোকামাকড়ের বৃদ্ধি ঘটায়। এইভাবে সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে বজায় রাখে।
চ্যাপুল স্থানীয় কৃষিক্ষেত্র, গবেষক ও কৃষকদের সঙ্গে মিলে কাজ করছে, যাতে ফ্রাসের উপকারিতা সম্পর্কে গবেষণা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়।
জৈব বর্জ্যের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে এবং এটি কার্বন নির্গমন ও জ্বালানি ব্যবহারের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করছে। তাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আরও কার্যকর ও টেকসই সমাধানের প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছে।
এখানেই বিএসএফএল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ এর পরিপাক প্রক্রিয়া উল্লেখযোগ্যভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করতে সক্ষম।
তবে শানমুগাম সতর্ক করে বলেন, 'এর ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ফ্রাসকে সার হিসেবে বাজারজাত করতে হলে এটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার, যা সময়সাপেক্ষ। আর এই নিয়মকানুন সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।'
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অর্গানিক প্রোগ্রাম (এনওপি) এখনও কৃষিতে পোকার ব্যবহারকে অনুমোদিত উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে জৈবচাষে আগ্রহী কৃষকদের মধ্যে এই প্রযুক্তি জনপ্রিয় করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবে চ্যাপুল ফার্মসের মতো প্রতিষ্ঠান এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
রাসায়নিক সার সাধারণত দীর্ঘমেয়াদে মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেয়। কিন্তু ফ্রাস মাটির জীববৈচিত্র্য বাড়ায় এবং এতে থাকা বৈচিত্র্যময় ব্যাকটেরিয়া ও মাইক্রোবস মাটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে সহায়ক। এতে মাটির স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পায়, উদ্ভিদের প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, পানি ধারণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ব্যয়বহুল কৃত্রিম উপাদানের প্রয়োজন কমে আসে।

অন্যদিকে, বিভিন্ন সিন্থেটিক সার মাটির প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে, উপকারী ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলে এবং মাটির সুক্ষ্ম-প্রাকৃতিক পরিবেশকে দুর্বল করে ফেলে। এতে কৃষকদের আরও বেশি পরিমাণে ব্যয়বহুল কৃত্রিম উপাদান ব্যবহার করতে হয়।
এছাড়া, এই ধরনের সার উৎপাদনে প্রচুর জীবাশ্ম জ্বালানি প্রয়োজন হয় এবং এটি মাটির কার্বন সংরক্ষণের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
মাটিতে থাকা মাত্র ১ শতাংশ জীবাণুকে এখন পর্যন্ত চাষযোগ্য হিসেবে শনাক্ত করা গেছে। কিন্তু ফ্রাস মাটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটি সনাতনী পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসে মাটির পুষ্টি পুনরুদ্ধারের সুযোগ সৃষ্টি করছে, যা কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তাকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
ফ্রাস ব্যবহারের ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের কম পরিমাণে সার প্রয়োগেই মাটির উর্বরতা বজায় রাখা সম্ভব হবে। কারণ ফ্রাসের জীবাণুগুলো ধীরে ধীরে মাটির গুণমান উন্নত করে।
যেসব কৃষক ইতোমধ্যেই ফ্রাস ব্যবহার শুরু করেছেন, তারা ইতিবাচক ফল পাচ্ছেন। ওরেগন রাজ্যের ওয়াইন চাষি মিমি কাস্টিল বর্তমানে ফ্রাসের প্রভাব যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চাষ শুরু করছেন। পরিসংখ্যানগত গবেষণা এখনও প্রক্রিয়াধীন হলেও তিনি ইতোমধ্যেই লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখতে পেয়েছেন।
তিনি বলেন, 'আমরা দেখেছি আঙ্গুর গাছ ও সবজি—উভয়ের ক্ষেত্রেই দ্রুত ফসল বেড়ে উঠছে। এসব উদ্ধিদের পাতাগুলো মাইক্রোস্কোপে দেখলে দেখতে পাওয়া যায়, পত্রকোষগুলো আরও ঘনভাবে গঠিত এবং অধিক শক্তিশালী। অর্থাৎ, শুরু থেকেই গাছের কাঠামো আরও মজবুত হচ্ছে।'
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পোকার প্রোটিন বাজারের মূল্য ২০২২ সালের হিসাবে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ফ্রাসের বাজার মূল্য মাত্র ৯৬ মিলিয়ন ডলার (২০২৩ সালে)। কিন্তু ভবিষ্যতে ফ্রাসের বাজারের প্রবৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া, একটি পোকার ফার্ম থেকে লার্ভার তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণ ফ্রাস উৎপাদিত হয়।
পোকামাকড় পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু পোকাকে 'কিস্টোন স্পিসিজ' বলা হয়। এই প্রাণীগুলো বিলুপ্ত হলে পুরো বাস্তুসংস্থান বিপর্যস্ত হতে পারে।
জীববিজ্ঞানী ডেভ গুলসন বলেন, 'পোকা ছাড়া আমাদের পৃথিবী কার্যত থমকে যাবে।'
চ্যাপুল ফার্মসের প্রধান নির্বাহী প্যাট ক্রাউলি বলেন, 'প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানগুলো পোকা ছাড়া কখনোই পূর্ণতা পাবে না। কৃষির বর্তমান সংকটগুলো শুধু পোকার মাধ্যমে সমাধান হবে না এটা সত্য। তবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়, যার মাধ্যমে আমরা কৃষিকে আরও স্থিতিশীল ও পরিবেশবান্ধব করে তুলতে পারি।'