সবকিছুতে ‘লাইক’ দেওয়ার মানে কি আপনি বুড়িয়ে গেছেন?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ২০০৯ সালের আগে 'লাইক' বাটন ছিল না। ইউটিউবে এটি যোগ হয় ২০১০ সালে। ওই বছরই আসে ইনস্টাগ্রাম, যা 'লাইক'-এর সংস্কৃতিকে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করে তোলে।
২০১৯ সালে সেলেনা গোমেজের ইনস্টাগ্রামে চার মিলিয়ন 'লাইক' পাওয়া ছবিটি এখনকার তুলনায় খুবই সামান্য। বর্তমানে সর্বোচ্চ 'লাইক' পাওয়া ছবির রেকর্ড লিওনেল মেসির দখলে। ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে তার পোস্ট করা ছবিটি পেয়েছে প্রায় ৭৫ মিলিয়ন 'লাইক'।
যদিও ব্যবহারকারীরা বিনামূল্যে 'লাইক' দিতে পারেন, তবু বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে এর অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। পর্যাপ্ত 'লাইক' পেলে তা আয়ের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এই সপ্তাহে তুচ্ছ এক কারণেই 'লাইক' আবারও আলোচনায় এসেছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের দাবি, স্প্যানিশ ফুটবল তারকা ইকার ক্যাসিয়াস অস্বাভাবিকভাবে অতিরিক্ত 'লাইক' দিচ্ছেন।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বামপন্থী সদস্য ইরেনে মনতেরো থেকে শুরু করে মাদ্রিদের উদারপন্থী আঞ্চলিক প্রধানমন্ত্রী ইসাবেল দিয়াজ আয়ুসো— সবাই তার 'লাইক'-এর তালিকায় রয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এত বেশি ছবিতে 'লাইক' দিয়ে ক্যাসিয়াস উল্টো নিজের গোপনীয়তা রক্ষা করছেন এবং গুজব ছড়ানোর প্রবণতা থেকে বাঁচার কৌশল গ্রহণ করছেন।
তবে মিম নির্মাতারা এটিকে নিছক রসিকতা হিসেবে নেয়নি। তারা ক্যাসিয়াসের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি এটিকে প্রজন্মগত ব্যবধানের প্রতিফলন হিসেবেও দেখছে। তাদের ধারণা, বয়স্করা তুলনামূলকভাবে বেশি উদারভাবে 'লাইক' ব্যবহার করেন।
প্রাথমিকভাবে 'লাইক' অলসতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। এটি এমন একটি ফিচার, যার মাধ্যমে মন্তব্য করার ঝামেলা এড়িয়ে সহজেই অন্যের কনটেন্টে সমর্থন জানানো যেত।
কোনো ছবিতে 'লাইক' দেওয়ার অর্থ দাঁড়াত, ব্যবহারকারী সেটি পছন্দ করেছেন, তবে মন্তব্য করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। এরপরই কে কার পোস্টে 'লাইক' দিল এবং কে দিল না—তা নজরদারি করতে শুরু হলো 'লাইক মনিটর'।
অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো 'লাইক'-এরও একটি স্বতন্ত্র ভাষা তৈরি হয়েছে, যার ভেতরে লুকিয়ে আছে নানা তাৎপর্য। ২০১৯ সালে ইনস্টাগ্রাম জনপ্রিয়তার চাপ ও মানসিক উদ্বেগ কমাতে 'লাইক'-এর সংখ্যা লুকানোর অপশন চালু করে।
তবে ২০২২ সালে 'লাইক' আরও ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। এখন ব্যবহারকারীরা ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতেও 'লাইক' দিতে পারেন। তবে এটি শুধু ডিজিটাল দুনিয়ায় সীমাবদ্ধ নেই। বাস্তব জীবনেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
যেমন, দোকানের পণ্যের 'রিভিউ বাটন' বা রাইড-শেয়ারিং অ্যাপে চালকদের দক্ষতা নির্ধারণে ব্যবহৃত অ্যালগরিদম—সবই 'লাইক'-এর বিবর্তিত রূপ। বর্তমানে আমরা এমন এক বাস্তবতায় বাস করছি, যেখানে আমাদের সামাজিক যোগাযোগ, অর্থনীতি এবং আত্মপরিচয়ের সংজ্ঞাকে নিয়ন্ত্রণ করছে ছোট্ট একটি 'লাভ রিয়্যাক্ট'।
স্বৈরশাসনে নাগরিকদের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রবণতা তৈরি হয়। একইভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যবহারকারীরা এখন বিচার-বিবেচনা করে 'লাইক' দেন।
একটি সেলফি, খানিকটা খোলামেলা ছবি, পারিবারিক মুহূর্ত বা কোনো শিশুর ছবিতে 'লাইক' দেওয়ার প্রবণতা বেশি। অন্যদিকে, শুধু লেখা পোস্টে 'লাইক' দেওয়ার আগ্রহ তুলনামূলকভাবে কম। কেউ কেউ খোলামেলাভাবে 'লাইক' দেন, আবার কেউ এক্ষেত্রে বেশ কৃপণতা করেন।
টিনএজারদের নাচে-ভরা টিকটকের তুলনায় ইনস্টাগ্রাম এখন যেন ত্রিশোর্ধ্বদের রাজত্বে পরিণত হয়েছে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, ১৮-২৪ বছর বয়সিরাই এখনো ইনস্টাগ্রামের প্রধান ব্যবহারকারী।
২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, এই বয়সিদের সংখ্যা ছিল মোট অ্যাকাউন্টের ৩১.৭ শতাংশ, যা ২৫-৩৪ বছর বয়সিদের (৩০.৬ শতাংশ) তুলনায় কিছুটা বেশি।
সাংবাদিক লুকাস বারকেরো (২৪) বলেন, 'পরিণত সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা কম 'লাইক' দেন। আমি খুব কম রিলস বা পোস্টে 'লাইক' দিই। আগে নির্বিচারে 'লাইক' দিতাম, যাতে অন্যরাও আমাকে 'লাইক' দেয়। এখন যা সত্যিই ভালো লাগে, শুধু সেটাতেই 'লাইক' দিই।'
বারকেরোর পর্যবেক্ষণ দেখিয়ে দেয়, বয়স অনুযায়ী 'লাইক'-এর ব্যবহার কীভাবে বদলায়। তিনি বলেন, 'অনেক সময় পুরোনো ছবিতে 'লাইক' আসলে মনে হয় কেউ হয়তো ফ্লার্ট করার চেষ্টা করছে। পরে দেখা যায়, সেটি আমার দাদির বয়সি আত্মীয়, যিনি কেবল পুরোনো কোনো পোস্ট খুঁজে পেয়েছেন এবং সেটি পছন্দ করেছেন।
এখনকার দিনে ফ্লার্ট করার সবচেয়ে সাধারণ উপায় হলো স্টোরিতে 'লাইক' দেওয়া। এটি এতটাই অস্পষ্ট যে এর অর্থ যেকোনো কিছু হতে পারে। অন্যদিকে, কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের পোস্টে দেওয়া 'লাইক' দেখে বোঝা যায় কে কোন মতাদর্শের অনুসারী। এটি কখনো কখনো সমাজবৈজ্ঞানিক গবেষণারও উপাদান হয়ে ওঠে।'
'লাইক' দেওয়া কখনো সন্দেহের কারণও হতে পারে। কোনো জনপ্রিয় ব্যক্তি বিশেষ মতাদর্শের কোনো পোস্টে 'লাইক' দিলে সেটি তাকে সেই আদর্শের অনুসারী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। আবার, নির্দিষ্ট ব্যক্তির পোস্টে 'লাইক' দেওয়া ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েনও সৃষ্টি করতে পারে।
বারকেরো বলেন, ''লাইক' অনেক সময় সূক্ষ্ম বিদ্রুপ বা নিষ্ক্রিয় আক্রমণের অস্ত্র হতে পারে। সরাসরি মেসেজে দেওয়া 'লাইক' নিরীহ দেখাতে পারে, তবে এটি পুরো কথোপকথন থামিয়ে দেওয়ার এক শক্তিশালী উপায়।'
অর্থাৎ, কারও কথায় 'লাইক' দেওয়ার মানে হলো আপনি কথাটি পছন্দ করেছেন, কিন্তু এতটাও নয় যে তার সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যাবেন। এটি অনেকটা পার্টিতে কাউকে দেখে অর্ধেক হাসি দিয়ে অন্য অতিথির সঙ্গে কথা বলতে চলে যাওয়ার ডিজিটাল সংস্করণ।
তবে সরাসরি মেসেজে 'লাইক' দেওয়া আর কোনো পোস্টের কমেন্টে 'লাইক' দেওয়া এক জিনিস নয়। কমেন্টে 'লাইক' দেওয়া তুলনামূলকভাবে আরও অর্থবহ। এটি সাধারণত চমৎকার কোনো মন্তব্যের জন্যই সংরক্ষিত থাকে। পোস্টের মালিক 'লাইক' দিয়ে বোঝান যে তিনি মন্তব্য দেখেছেন এবং সেটি সমর্থন করেছেন।
কলাম লেখক এনরিক রে-এর মতে, 'লাইক'-এর অর্থ নির্ভর করে এটি যে প্ল্যাটফর্মে দেওয়া হচ্ছে তার ওপর। যেমন, ফেসবুকে দেওয়া 'লাইক' সবচেয়ে মূল্যবান। এটি এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তাশীল প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে।
অন্যদিকে, এক্স (সাবেক টুইটার)-এ দেওয়া 'লাইক'কে রিটুইটের তুলনায় কিছুটা কম গুরুত্বের সঙ্গেই দেখা হয়। আর ইনস্টাগ্রামের 'লাইক' প্রায়শই সরাসরি রোমান্টিক ইঙ্গিত বহন করে।'
এনরিকে আরও বলেন, ''আমি 'লাইক'-এর ক্ষেত্রে বেশ উদার। সাধারণত আমি যাদের পছন্দ করি, তাদের প্রতিদিনের সাধারণ পোস্টগুলোতেও 'লাইক' দিই। পোস্টের বিষয়বস্তু আমার কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ধরুন, কেউ একটা প্লেট ভর্তি পাস্তা পোস্ট করল। আমি পাস্তা পছন্দ না করলেও 'লাইক' দিই। এতে বোঝাতে চাই, 'অন্তত রান্না করার শক্তি পেয়েছো, তুমি একজন যোদ্ধা।'
প্রশ্ন হলো, রে'র মতো যারা সবকিছুতেই 'লাইক' দিয়ে থাকেন, তারা সত্যিই কোনো পোস্ট পছন্দ করলে কী করেন? যেহেতু এখন 'লাইক'-এর অর্থ অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে, তাই সত্যিকারের ভালো লাগা প্রকাশ করতে 'লাইক' দেওয়ার পাশাপাশি মন্তব্যও করা উচিত।