তালাবদ্ধ পড়ার ঘর থেকে মিলেছিল ডেভিড বোয়ির শেষ গোপন প্রজেক্ট

ডেভিড বোয়ি ২০১৬ সালে মারা যাওয়ার আগে রেখে গিয়েছিলেন তার শেষ অ্যালবাম ব্ল্যাকস্টার। ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই আর মৃত্যুকে মেনে নেওয়ার স্বীকারোক্তি যেন গানে গানে প্রকাশ করেছিলেন তিনি। কিন্তু সবার অজান্তেই জীবনের শেষ কয়েক মাসে আরেকটি কাজ শুরু করেছিলেন এই সঙ্গীত কিংবদন্তি—একটি আঠারো শতকের প্রেক্ষাপটে নির্মিত মিউজিক্যাল বা নাট্যসঙ্গীত, নাম দিয়েছিলেন 'দ্য স্পেকটেটর'।
অবাক করার মতো বিষয় হলো, প্রকল্পটির অস্তিত্বই জানতেন না তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগীরাও। মৃত্যুর পর নিউইয়র্কে তার ব্যক্তিগত পড়ার ঘরে তালাবদ্ধ অবস্থায় যখন নোটগুলো আবিষ্কৃত হয়, তখনই প্রথম জানা যায় এ নিয়ে। সম্প্রতি সেসব নোট যুক্তরাজ্যের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে বোয়ির পুরো আর্কাইভের সঙ্গে দান করা হয়েছে।
বোয়ির নোটগুলো পাওয়া যায় ঠিক যেভাবে তিনি রেখে গিয়েছিলেন—দেয়ালে টাঙানো কিংবা অফিসে গুছিয়ে রাখা অবস্থায়। তার এই ঘরটি সবসময় তালাবদ্ধ থাকত। চাবি ছিল কেবল বোয়ি ও তার ব্যক্তিগত সহকারীর কাছে। তাই তিনি মারা যাওয়ার পর সংরক্ষণবিদরা যখন জিনিসপত্র গোছানো শুরু করেন, তখন পর্যন্ত নোটগুলো অক্ষত ছিল।
কালো কালি দিয়ে বোয়ি নোট লিখেছিলেন। বেশ কিছু প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ করেছিলেন এবং প্রত্যেকটিকে নম্বরও দিতেন। বিশেষভাবে তার নজর কেড়েছিল দুই বোনকে ঘিরে একটি নৈতিক কাহিনি—একজন সুন্দরী কিন্তু অহংকারী, অন্যজন সাধারণ চেহারার হলেও মিশুক। শেষ পর্যন্ত সুন্দরী বোন প্রেম হারান সাধারণ চেহারার বোনের কাছে। বোয়ি এটিকে ৮/১০ নম্বর দিয়ে লিখেছিলেন—'একটি ভালো উপকাহিনি হতে পারে।'
আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর লন্ডনের হ্যাকনি উইকে খুলছ, 'ডেভিড বোয়ি সেন্টার অ্যাট দ্য ভি অ্যান্ড এ ইস্ট স্টোরহাউস'। প্রায় ৯০ হাজার উপকরণের বিশাল আর্কাইভ থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে ২০০টি প্রদর্শনীর জন্য। তবে ইচ্ছা করলে আবেদন করে গবেষকরা ঘেঁটে দেখতে পারবেন পুরো আর্কাইভ।
সংগ্রহশালার কিউরেটর মাদেলেইন হ্যাডন জানালেন, 'আমাদের কাছে এমনকি সেই ডেস্কটিও আছে, যেখানে বসে তিনি কাজ করতেন।'
বোয়ি-র নোটে ওঠে এসেছে আঠারো শতকের লন্ডন—ব্যঙ্গ, সংস্কৃতি, অপরাধ আর রোমাঞ্চের শহর। তাকে মুগ্ধ করেছিল জ্যাক শেফার্ডের গল্প—একজন চোর, যিনি জনমানসে নায়ক হয়ে উঠেছিলেন। বিপরীতে ছিলেন জনাথন ওয়াইল্ড, যিনি আইনরক্ষকের মুখোশে শেফার্ডকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন মৃত্যুর মুখে। বোয়ি কল্পনা করেছিলেন তাদের দ্বন্দ্বকে নাটকের কেন্দ্রে দাঁড় করাতে।
আরও ছিল মোহকস নামে এক দস্যু গ্যাং। রাতের আঁধারে মাতাল অভিজাত তরুণেরা রাস্তায় নেমে আক্রমণ করত সাধারণ মানুষকে। বোয়ি লিখেছেন, এক চরিত্রকে তারা আক্রমণ করছে—এ দৃশ্য হয়তো তাঁর মঞ্চে জীবন্ত হয়ে উঠত।

অক্সফোর্ডের ইতিহাসবিদ বব হ্যারিস বলছেন, 'সে সময়ের লন্ডন ছিল বৈপরীত্যে ভরা শহর। উচ্চ-নিম্ন, নৈতিকতা আর অপরাধ পাশাপাশি ছিল। বোয়ি সেই দ্বন্দ্বেই সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিলেন।'
কিউরেটর মাদেলেইন হ্যাডন মনে করেন, বোয়ি শুধু চরিত্র বা গল্প নয়—খুঁজছিলেন শিল্পীরা কীভাবে রাজনৈতিক ব্যঙ্গকে হাতিয়ার করেছিলেন। 'তিনি হয়তো আলোকায়নের যুগের সঙ্গে নিজের সময়ের তুলনা করছিলেন। ভাবছিলেন, শিল্প কি এখনও পরিবর্তনের শক্তি হতে পারে?'
২০০২ সালে এক সাক্ষাৎকারে বোয়ি বলেছিলেন, 'শুরু থেকেই আমি থিয়েটারের জন্য লিখতে চেয়েছিলাম।' দ্য স্পেকটেটর হয়তো সেই অপূর্ণ ইচ্ছারই পূর্ণতা হতো—যদি তিনি বেঁচে শেষ করতে পারতেন।
এখন সেই অসমাপ্ত স্বপ্ন জায়গা করে নিয়েছে মিউজিয়ামের সংগ্রহে।
কিউরেটর হ্যাডনের আশা, এই আর্কাইভ শুধু স্মৃতি নয়, নতুন প্রজন্মের জন্য হবে অনুপ্রেরণার ভাণ্ডার। 'আজকের তরুণরা এক ঘরানায় নিজেদের আটকে রাখতে চায় না। বোয়িও ছিলেন তেমনই এক পথিকৃত। আশা করি, মানুষ এখানে এসে তাঁর সৃজনশীল প্রক্রিয়া থেকে নিজের জন্য নতুন কিছু শিখে নেবে,' তিনি বলেন।