তফসিল ঘোষণার পর আচরণবিধি ভেঙে নির্বাচনী প্রচারণায় প্রার্থীরা
নির্বাচনী আচরণবিধিতে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গতকাল ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রার্থী ও তাদের সমর্থকেরা প্রচারণা কার্যক্রম চালিয়েছেন। আচরণবিধি অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার পর নির্ধারিত সময়ের আগে যেকোনো ধরনের নির্বাচনী প্রচার নিষিদ্ধ।
এর আগে, বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন।
নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, ২০২৬ সালের ২২ জানুয়ারির আগে কোনো প্রার্থী বা তাদের সমর্থকেরা সভা-সমাবেশ করতে বা ভোট চাইতে পারবেন না। এ বিধি লঙ্ঘন করলে প্রার্থিতা বাতিলসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
তবে এসব নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তফসিল ঘোষণার পরপরই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা সভা-সমাবেশ ও প্রচারণামূলক কার্যক্রম শুরু করেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অনুসন্ধানে দেশজুড়ে এ ধরনের অন্তত শতাধিক ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে।
তফসিল অনুযায়ী, আগামী ২২ জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়ে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত চলবে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানিয়েছে, এ সময়সীমার বাইরে—এমনকি প্রতীক বরাদ্দের পরও—কোনো ধরনের প্রচারণা চালানো যাবে না।
নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তফসিল ঘোষণার কিছুক্ষণ পরই আচরণবিধি ভেঙে কারওয়ানবাজার এলাকায় কয়েকশ নেতাকর্মী নিয়ে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট চেয়ে মিছিল করেন ঢাকা-১২ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব।
শুক্রবার সকালে একই আসনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী সাইফুল আলম খান মিলন একটি সমাবেশের আয়োজন করেন। তবে আচরণবিধির কথা উল্লেখ করে তিনি মাঝপথেই সমাবেশটি স্থগিত করেন।
সমাবেশ স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, "নির্বাচনী সভা করা যাবে না, দলের প্রতীকের কথা বলা যাবে না—এমন একটি আশ্চর্যজনক অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী সবসময় আইন মেনে চলে। তাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি এই সভা স্থগিত ঘোষণা করছি।"
ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে বিএনপির 'দেশ গড়ার পরিকল্পনা' শীর্ষক কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি ছিলেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। অনুষ্ঠানটির ব্যানারে সরাসরি নির্বাচনী প্রচারণার উল্লেখ না থাকলেও বক্তাদের বক্তব্যে নির্বাচনী প্রচারণা ও দলীয় প্রতীকে ভোট দেওয়ার আহ্বানই প্রাধান্য পায়।
এছাড়া বিকেল ৩টার দিকে কলাবাগান থেকে ধানমন্ডি পর্যন্ত একটি বিজয় র্যালিতে অংশ নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্ত হন সদ্য বিদায়ী উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া।
ঢাকার বাইরেও নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।
এনসিপি নেতা হান্নান মাসউদ তার নির্বাচনী এলাকা নোয়াখালীর হাতিয়ায় কয়েকশ নেতাকর্মী নিয়ে দলীয় প্রতীক শাপলা কলির প্রচারণা চালান।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বাগেরহাট-৩ আসনে মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট মাওলানা শেখ আব্দুল ওয়াদুদ শুক্রবার গণসংযোগ করেন। সকালে তিনি পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে প্রচারণা শুরু করে নেতাকর্মীদের সঙ্গে লিফলেট বিতরণ করেন।
বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী আবুল হোসেন খান পাদ্রীশিবপুর ইউনিয়নে পথসভা করেন। এতে কয়েকশ মানুষ অংশ নেন এবং তিনি ও নেতাকর্মীরা স্থানীয়দের মধ্যে লিফলেট বিতরণ করেন।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় ১ নম্বর কামদিয়া ইউনিয়ন বিএনপির উদ্যোগে ২ নম্বর ওয়ার্ডে ধানের শীষের নির্বাচনী উঠান বৈঠক ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে গাইবান্ধা-৪ আসনের বিএনপির মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ শামীম কায়সার লিংকন অংশ নেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনে কসবা উপজেলার মেহারী ইউনিয়নে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দলসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে বিএনপি প্রার্থী মুশফিকুর রহমানের ধানের শীষ প্রতীকের নির্বাচনী সভা ও অনুষ্ঠিত হয়।
নেত্রকোণা-২ আসনের আমতলা ইউনিয়নে আমতলা রাধা-গোবিন্দ মন্দির কমিটির উদ্যোগে সনাতনীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নিয়ে বিএনপি প্রার্থী ডা. মো. আনোয়ারুল হক ধানের শীষে ভোট চান।
এছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জুমার নামাজের আগে ও পরে মসজিদে উপস্থিত মুসল্লিদের কাছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দোয়া ও ভোট চান।
এদিকে আচরণবিধি ভঙ্গের পাশাপাশি কয়েকটি স্থানে পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ আচরণবিধি মেনে স্থগিত করার ঘটনাও ঘটেছে। কিছু দল আচরণবিধি মানার নির্দেশনাও দিয়েছে।
শুক্রবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর পূর্বনির্ধারিত সব সমাবেশ ও নির্বাচনী প্রচারণা বাতিল করেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, "ঘোষিত নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও সফল করতে যৌক্তিক সব ধরনের সহযোগিতার জন্য আমরা প্রস্তুত। ঘোষিত আরপিও অনুযায়ী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিভিন্ন প্রচার উপকরণ নিজ নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নেওয়ার জন্য দেশের সব পর্যায়ের দায়িত্বশীল ও কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানাই।"
ঢাকার অন্তত তিনটি স্থানে জামায়াতের পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ স্থগিতের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিরও একটি সমাবেশ স্থগিত করা হয়।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্ধারিত সময়ের আগে কোনো ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা বা সভা-সমাবেশের সুযোগ নেই। যারা এটি করছে তারা আরপিওর বিধিমালা লঙ্ঘন করছে।"
"বিষয়গুলো দেখার জন্য আমাদের নিয়োগকৃত ম্যাজিস্ট্রেটরা দায়িত্ব পালন করবেন। অভিযোগ পেলে বা তাদের নজরে এলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে," যোগ করেন তিনি।
