পারিবারিক বিরোধের জের! জুলাই আন্দোলনের ৩ মামলায় আসামি এক পরিবারের ৪ জন

আবদুল আলীম বাবুর্চি, বয়সে ৭০ এর কাছাকাছি। যিনি গত ৩৮ বছর ধরেই কক্সবাজারে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মালিকা্নাধীন মোটেল শৈবালের বাবুর্চি হিসেবে কর্মরত। যার মধ্যে ৩২ বছর নিয়মিত চাকুরি শেষে চুক্তিভিত্তিক কাজ করে যাচ্ছেন ৬ বছর ধরে। তিনি ইতোমধ্যে জুলাই আন্দোলনের হতাহতের ঘটনায় ঢাকা এবং চট্টগ্রামে পৃথকভাবে দায়ের করা দুইটি মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি। যার একটি ঢাকার বাড্ডা থানায় চলতি বছরের ২৩ জুলাই দায়ের করা মামলা। অপর মামলাটি চট্টগ্রাম চীফ মেট্রোপলিটর আদালতে গত ১ সেপ্টেম্বর দায়ের করা হয়।
শুধু তিনি নন, তার বড় মেয়ে সোনিয়া আকতার এজাহারভূক্ত আসামি হয়েছেন বাড্ডা থানার মামলায়, যেখানে তার বাবাও আসামি। সোনিয়া আরও একটি মামলার এজাহারভুক্ত। যে মামলাটি ঢাকার লালবাগ থানায় গত ১৭ জুলাই দায়ের করা।
একইভাবে আলীম বাবুর্চির ছোট্ট মেয়ের জামাতা আবু সুফিয়ান সজীব শ্বশুর আসামি হওয়া মামলা দুইটির আসামি।
আলীমের ছেলে খায়রুল আলম জেকি আসামি হয়েছেন চট্টগ্রামে আদালতে দায়ের করা মামলায়।
একই পরিবারের এই ৪ জনের বিরুদ্ধে ঢাকা ও চট্টগ্রামের দায়ের করা মামলার ৩টির মধ্যে ২টির এজাহার টিবিএসের প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। তবে ঢাকার বাড্ডা থানার ,এফআইআর নং-৩৬, তারিখ- ২৩ জুলাই, ২০২৫; জি আর নং-২৫৪, তারিখ- ২৩ জুলাই, ২০২৫ মামলাটির এজাহার পাওয়া যায়নি।
এজাহার পাওয়া চট্টগ্রাম চীফ মেট্রোপলিটর আদালতে গত ১ সেপ্টেম্বর (২০২৫) দায়ের করা মামলাটির বাদি একেএম নুরুল্লাহ। তিনি সীতাকুন্ডের সোনাইছড়ি পাকা মসজিদ এলাকায় বসবাসকারী মো. রতন মিয়ার ছেলে। এজাহারে উল্লেখ করেছেন, তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্বপক্ষের একজন সক্রিয় যোদ্ধা।
এজাহারে ঘটনার তারিখ দেখানো হয়েছে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে। ঘটনাস্থল চট্টগ্রামের কোতয়ালি থানার পশ্চিম নিউমাকের্ট থেকে সিটি কলেজ ও রেলওয়ে জামে মসজিদের পাশে। ওইদিন ওখানে বাদী নিজেই গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত এবং অনেকেই নিহত হন বলে এজাহারে বলা হয়েছে। ১৮২ জনের নাম উল্লেখ করে দায়ের করা মামলায় প্রধান আসামি ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ওই মামলাটির ৫৭ নম্বর এজাহারভুক্ত আসামি আ. আলীম বাবুর্চি। এজাহারে মোবাইল নম্বর, পিতা-মাতার নাম উল্লেখ করে ঠিকানা বলা হয়েছে কক্সবাজার শহরের উত্তর বাহারছড়া। শৈবালে কর্মরত এটাও লেখা রয়েছে। স্থায়ী ঠিকানা নারায়ণগঞ্জ তা-ও বলা হয়েছে।একই মামলার ৬২ নম্বর আসামি আলীম বাবুর্চির ছোট্ট মেয়ের জামাতা আবু সুফিয়ান সজীব। যেখানে সজীবের ফোন নম্বর উল্লেখ করে বড় মহেশখালীর ঠিকানা উল্লেখ করে বলা হয়েছে দুর্দান্ত ছাত্রলীগ ক্যাডার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী ক্যাডার। মামলাটির ৯৭ নম্বর আসামি ছেলে খায়রুল আলম জেকি। তাকে বাদীর হত্যা চেষ্টায় সরাসরি জড়িত বলে উল্লেখ রয়েছে।
গত ১৭ জুলাই দায়ের করা ঢাকার লালবাগ থানার মামলার নম্বর ৫-এর বাদি মো. আশরাফ কেরানীগঞ্জের মোহাম্মদ কায়েসের ছেলে।
ওই মামলাটির ঘটনাস্থল ও সময় ১৮ জুলাই ২০২৪, রাত সাড়ে ৮টার দিকে। আজিমপুর সরকারি মধ্য কলোনি এলাকা। ওই মামলারও প্রধান আসামি শেখ হাসিনা। মামলাটির ৪১ নম্বর আসামি সোনিয়া আকতার– আলীমের বড় মেয়ে। তাকে লালবাগের যুব মহিলীলীগের নেত্রী উল্লেখ্য করে কক্সবাজারের উত্তর বাহারছড়ার ঠিকানাটি লেখা রয়েছে।
সোনিয়াকে বলা হয়েছে, লালবাগ যুব মহিলালীগের নেত্রী। সোনিয়া বলেছেন, "আমি সাধারণ নারী, রাজনীতির সাথে কোনভাবেই যুক্ত না।"
আবদুল আলীম বাবুর্চি জানিয়েছেন, গত ৩ বছরে তাঁর কোনোদিন কক্সবাজারের বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। "মামলার এজাহারে ঘটনার সময় যে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে— ওই দিনও আমি নিজের কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলাম।"
এসংক্রান্ত দায়ের করার মামলার দুইটি এজাহারে ছোট্ট মেয়ের জামাতা আবু সুফিয়ান সজীব বলা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী ক্যাডার। অথচ এই সজীবের জীবনে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা-পড়ার সুযোগ হয়নি। তিনি বলেছেন, "আমি কলেজ জীবনেই পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।"
ছেলে খায়রুল আলম জেকিও থাকেন কক্সবাজার। করেন না কোনো রাজনীতি। তিনিও ঘটনার তারিখের দিন কক্সবাজার শহরেই ছিলেন।
তাহলে কেন একই পরিবারের এই ৪ জনকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে। এমন প্রশ্নের উত্তরে ওই পরিবারের সন্দেহের তীর একজনের দিকে। তিনি জাকের হোসেন, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এলাকার বাসিন্দা। তার সাথে আলীম বাবুর্চির বড় মেয়ে সোনিয়ার ৭ বছরের সংসারের পর বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে ২০২৪ সালের ৭ নভেম্বর।
আবদুল আলীম বাবুর্চি জানিয়েছেন, জাকের হোসেন তথ্য গোপন করে ২০১৭ সালে তার বড় মেয়ে সোনিয়াকে বিয়ে করে। বিয়ের কয়েক বছর পরে জানা যায়, গ্রামের বাড়িতে তার আগের পক্ষের স্ত্রী-সন্তান রয়েছে। এটা জানার পর দুই জনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এই বিরোধের জের ধরে ২০২৪ সালের নভেম্বর তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। তিনি বলেন, "এরপর থেকে জাকের নানাভাবে অপপ্রচার করে আমাকে এবং মেয়েকে হেয় করার চেষ্টা শুরু করে। এমনকী ক্ষতি করার জন্য নানাভাবে হুমকিও দিয়ে আসছে। তারই অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে মামলার বাদী বা অন্য কাউকে টাকার বিনিময়ে আমার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করা হচ্ছে।"
ছোট্ট মেয়ের জামাতা আবু সুফিয়ান সজীব বলেন, "মামলায় আমাকে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের ক্যাডার বলা হয়েছে, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার লেখা-পড়ার বা ভর্তির সুযোগ হয়নি। আমার লেখাপড়া শেষ কলেজ জীবনে। আমি রাজনীতি করি না। সাধারণ পরিবারের সন্তান হয়ে কোনো প্রকারে জীবিকা নির্বাহ করি। জাকের হোসেন নামের ব্যক্তির সাথে আমার স্ত্রীর বড় বোনের ডিভোর্সের প্রতিশোধের বলি হচ্ছি আমরা।"
সোনিয়া আকতার বলেন, ডির্ভোসের পর তিনি চাকুরি করে জীবিকানির্বাহ করে যাচ্ছেন। "ডিভোর্স হওয়ার পর থেকে জাকির হোসেন আমাকে নানাভাবে ক্ষতি করার চেষ্টায় আছে। এমনকী মামলা হওয়ার পরও আমাদের (জুলাই আন্দোলনের) মামলার আসামি করার কথা স্বীকার করে— আরও মামলার আসামি করা হবে বলে হুমকি দিচ্ছেন।"
বাহারছড়া নবজাগরণ সমিতির সভাপতি আলী হোসেন জানান, "দীর্ঘ ৪০ বছরের কাছাকাছি সময় আবদুল আলীম বাহারছড়ায় বসবাস করে আসছেন। তিনি বা তার পরিবারের ছেলে-মেয়েরা কোনো সময় রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়েছেন, এমনটা দেখা যায়নি। কিন্তু চট্টগ্রাম ও ঢাকার মামলায় তারা আসামি হয়েছেন। এটা খুব দুঃখজনক।"
এব্যাপারে জাকের হোসেন, চট্টগ্রাম চীফ মেট্রোপলিটর আদালতে দায়ের করা মামলার বাদী একেএম নুরুল্লাহ এবং লালবাগ থানার মামলার বাদি মো. আশরাফের ফোন নম্বরের যোগাযোগ করা হলে তিন জনেরই ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।