ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের পর বেড়েছে ঢাকা থেকে এয়ার কার্গোর খরচ

ভারত যখন ৮ এপ্রিল নীরবে বাংলাদেশের কার্গো ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করল, তখন খুব কম মানুষই বুঝেছিল এর ধাক্কাটা এত দ্রুত বা তীব্র হয়ে আসবে। কিন্তু এক সপ্তাহও পেরোয়নি, এরইমধ্যে ঢাকাগামী এয়ার কার্গো ভাড়া বাড়তে শুরু করেছে। এতে হুমকির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। তার ওপরে এ খাতে মুনাফার মার্জিন ইতিমধ্যেই কমে এসেছে।
ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় পাঁচ বছর ধরে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে কলকাতা বা দিল্লির মতো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহনের যে সুবিধা পাচ্ছিল বাংলাদেশ, তা বন্ধ হয়ে গেছে। সেই করিডোর এখন বন্ধ—এবং তার সঙ্গে বন্ধ কম খরচের গুরুত্বপূর্ণ একটি লজিস্টিক বিকল্পও।
এর প্রভাব কী?
ঢাকা থেকে ইউরোপগামী এয়ার কার্গোর স্পট রেট কেজিপ্রতি ৬.৩০ ডলার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৫০ ডলার—যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এমনকি মহামারির সময়কেও ছাড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য পাঠাতে এখন কেজিপ্রতি ৭.৫০ থেকে ৮ ডলার গুনতে হচ্ছে—যেখানে ২০২৪ সালের আগস্টে এই রেট ছিল ৬.৯১ ডলার। অন্যদিকে কলকাতা থেকে কেজিতে এই খরচ মাত্র ৪ ডলার এবং মালদ্বীপ থেকে ৩.৫০ ডলার।
রপ্তানিকারকদের এখন বাড়তি চার্জও গুনতে হচ্ছে। এসব চার্জের মধ্যে রয়েছে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য কেজিতে ২.৫০ টাকা, স্ক্যানিংয়ের জন্য কেজিতে ২ টাকা, আর ওয়্যারহাউস স্টোরেজের ভাড়ার জন্য কেজিতে দৈনিক ২৫ পয়সা।
'এতে ব্যবসা পরিচালনার খরচ বেড়ে যাবে, লিড টাইম বাড়বে, এবং আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে আসবে,' বলেন টিএডি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন।
কিন্তু ভোগান্তির এখানেই শেষ নয়।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, এরইমধ্যে কিছু এয়ারলাইন থেকে নোটিশ পেয়েছেন, আগামী সপ্তাহে ভাড়া আরও বাড়তে পারে। ভাড়া বৃদ্ধির কারণ দেখানো হচ্ছে চাহিদা বেড়ে যাওয়া ও কার্গো স্পেস কমে যাওয়া। জরুরি হস্তক্ষেপ না হলে ভাড়া দ্বিগুণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শিল্পসংশ্লিষ্টরা।
তুহিন আরও বলেন, বাংলাদেশের আরেক সাম্প্রতিক নীতিগত সিদ্ধান্ত—স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করাও এই সংকটকে আরও তীব্র করেছে। 'প্রতি কেজি সুতায় আমাদের এখন ৬০ সেন্ট থেকে ১ ডলার বাড়তি খরচ হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে কেজিতে আরও ১ ডলার করে বিমান ভাড়া। দুদিক থেকে আঘাত এসেছে,' বলেন তিনি।
কিন্তু খরচ বাড়ার পরও বিমানবন্দরের সীমিত সক্ষমতার কোনো সমাধান এখনও আসেনি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি মো. শাহরিয়ার বলেন, তারা এখনও ইইউতে কেজিতে প্রায় ৬ ডলার খরচে পণ্য পাঠাতে পারছেন। কিন্তু ফরোয়ার্ডাররা তাকে জানিয়েছে, শনিবার থেকে বাজার অনুযায়ী রেট ঠিক হবে—অর্থাৎ খরচ আরও বাড়বে।
'সরকার যদি অবিলম্বে বাড়তি কার্গো সার্ভিস চালু না করে এবং বিমানবন্দরের জট না কাটায়, প্রধান বাজারগুলো থেকে আমরা ছিটকে পড়ব,' বলেন তিনি।
আরও গভীর কাঠামোগত সমস্যার দিকেও ইঙ্গিত করে শাহরিয়ার বলেন, বাংলাদেশের বিমানবন্দর চার্জ এই অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ, আর জেট ফুয়েল দামও বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশি। এসব বিষয় নীরবে খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
নীতিগত ভুল সিদ্ধান্ত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বিক লজিটিকসও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারকরা আশঙ্কা করছেন, আবারও তারা একা হয়ে পড়ছেন।
ভারত হয়ে কত কার্গো যেত?
ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার ও পোশাক রপ্তানিকারকদের তথ্যমতে, বাংলাদেশের সাপ্তাহিক এয়ার কার্গোর প্রায় ১৮ শতাংশ—অর্থাৎ প্রায় ৬০০ টন—ভারতের বিমানবন্দর দিয়ে পরিবাহিত হতো।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ৪৬২ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ৩৪ হাজার ৯০০ টনের বেশি পোশাকপণ্য ভারত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ ৩৬টিরও বেশি দেশে পাঠানো হয়।
বাংলাদেশের কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা সীমিত। ২০২৪ সালে এই বিমানবন্দরে প্রায় ২ লাখ টন রপ্তানিপণ্য এবং প্রায় ৫০ হাজার টন আমদানিপণ্য প্রক্রিয়াজাত হয়। এসব পণ্য বহনকারী প্রধান এয়ারলাইনের মধ্যে রয়েছে এমিরেটস এয়ারলাইনস, কাতার এয়ারওয়েজ, টার্কিশ, সৌদিয়া, ইতিহাদ ও বিমান বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক ফ্লাইট কম এবং কার্গো চাহিদা কম থাকায় দেশের বাকি দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর—সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর—নগণ্য পরিমাণ কার্গো হ্যান্ডল করেছে।
সমাধান আছে কি?
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাবেক পরিচালক কাজী ওয়াহিদুল আলম মনে করেন, দ্রুততম সমাধান নির্ভর করছে দুটি কাজের ওপর: ঢাকা বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল চালু করা এবং স্বল্পমেয়াদে কোনো তৃতীয় পক্ষের অপারেটরকে নিয়োগ দিয়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের উপযুক্ত করে তোলা।
তিনি বলেন, থার্ড টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা তিনগুণ হয়ে বছরে ৫.৪৭ লাখ টনে উন্নীত হতে পারে।
'ঢাকা বিমানবন্দরের বর্তমান ক্ষমতা জরুরি ভিত্তিতে বাড়ানো প্রয়োজন—কিন্তু তা করা হচ্ছে না। তিনটি স্ক্যানিং মেশিনের মধ্যে একটা প্রায় সবসময়ই অকেজো থাকে,' বলেন তিনি।
'দ্য বাংলাদেশ মনিটর' নামক অ্যাভিয়েশন ও পর্যটনবিষয়ক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ওয়াহিদুল আলম আরও বলেন, বিমানবন্দরে জায়গার সংকট, মালামাল হারিয়ে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগও নিয়মিত পাওয়া যায়।