রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: পরিস্থিতি কঠিন করে তুলছে দিনকে দিন!

বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় মেটানোর প্রধান বৈদেশিক মুদ্রার উৎস হচ্ছে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় ও বৈদেশিক কর্মীদের কাছ থেকে তাদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা। এ বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের আমদানি ব্যয় মিটানোর প্রধান উৎস। কিন্তু গত মাসে উভয় ক্ষেত্রেই অবনমন ঘটেছে।
রপ্তানি খাতে গত ১৩ মাসের মধ্যে এই প্রথম নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়ে আয় কমেছে ৬ শতাংশ। আর বৈদেশিক কর্মীদের কাছ থেকে পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ কমেছে ১১ শতাংশ।
সরকারের নানান প্রচেষ্টার পরেও প্রবাসীদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে না। পাশাপাশি পোশাকশিল্পের এই হাল আগামীতে আরো অবনতি হবে, কারণ বিশ্বব্যাপী ২৩ সালের যে অর্থনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে তার ফলে এ ঘটনা ঘটবে বলা যায়।
গত মাসের যে তথ্যচিত্র প্রকাশিত হয়েছে তা এক অর্থে ভয়ংকর। উভয় ক্ষেত্রেই বিরাট ধরনের পতন ঘটেছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে। শতাংশের হারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পোশাক শিল্পের আয় যে কমবে তা গত কিছুদিন যাবত গণমাধ্যম নানানভাবে তথ্য প্রকাশ করছিল। ক্রয় আদেশ কমে যাচ্ছে দ্রুত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে চলছে বড় ধরনের মুদ্রাস্ফীতি। আর মুদ্রাস্ফীতি ঘটলে প্রধান ভাবে আক্রান্ত হয় পোশাক । পোশাক ক্রয়ে মানুষ সাশ্রয়ী হওয়ার চেষ্টা করে। তারই লক্ষণ দেখা দিচ্ছে আমাদের পোশাক শিল্পে।
পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোয় একদিকে যুদ্ধ অন্যদিকে জ্বালানি সংকট এবং মুদ্রাস্ফীতি সবকিছু মিলিয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে আগামী দিনগুলো যে আরো কঠিন হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
দেশের আমদানি সংকোচন করতে যেয়ে আমাদের জ্বালানি খাত তীব্র সংকটের মুখোমুখি। গত কয়েক মাস ধরে গ্যাস অপ্রতুলতার কারণে দেশের নানা অংশের শিল্প উৎপাদন মারাত্মক ভাবে ব্যহত হচ্ছে। দেশের বর্তমান জ্বালানি খাত আমদানি নির্ভর হওয়াতে অদূর ভবিষ্যতে কতটা পরিবর্তন হবে তা বোঝা মুশকিল। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও গ্যাসের দাম কমেনি, বিশেষ করে আমাদের এলএনজি উৎসগুলোতে চাহিদা বাড়ায় দাম বেড়েছে।
পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো গ্যাস সংকটে ভুগছে । সেই কারণে তাদের দিক থেকেও এলএনজি ক্রয়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে।
আমদানি নির্ভর জ্বালানি খাতে এই মুহূর্তে দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার অবস্থাও আমাদের হাতে নাই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কার্বন নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে তাদের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছিল তা বর্তমান সংকটের কারণে পুনরায় চালু করেছে । জার্মানি এক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে। ইউরোপের দেশগুলো আবার তাদের পুরনো জ্বালানি ব্যবস্থা, কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো চালু করছে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র কখনো বন্ধ করেনি।
দেশের রাজনৈতিক বিভাজনের ফলে আমাদের দিনাজপুরের ৩০০ কোটি টন কয়লা মজুদ থাকার পরেও আমরা আমদানি নির্ভর কয়লা দ্বারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছি। দিনাজপুরের যে কয়লা মজুদ আছে তার প্রধান বিতর্ক ছিল উৎপাদন পদ্ধতি। সেখানকার মানুষদের কৃষি জমি বিনষ্ট হওয়ার বিষয়। সে সময়ের দেশের সবচেয়ে বুদ্ধিমান অগ্রসর রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গড়ে উঠেছিল "তেল গ্যাস বন্দর রক্ষা আন্দোলন"। যে আন্দোলনের পরিণতিতে দিনাজপুর অঞ্চলে ২০০৬ সালে রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটেছে। ফলে সরকারের এবং বিরোধী দল উভয়পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হল যে ভবিষ্যতে এখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হবে না।
আমাদের দেশে জমি অধিগ্রহণ করা নিয়েও অতীতে নানান সংকট ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে উন্নয়নের প্রয়োজনে সরকার কর্তৃক যে জমি অধিগ্রহণ করা শুরু হলো তার মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতি বাজার মূল্যর থেকে তিনগুণ মূল্য প্রদানের সিদ্ধান্ত। সরকারকে জমি অধিগ্রহণ করার ক্ষেত্রে গত ১০ বছরে নতুন কোন সংকট দেখে দেয়নি।
দিনাজপুরের কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করলে যারা ভূমিহারা হতো তাদের পুনর্বাসন একাধিক পদ্ধতিতে করা যেতে পারতো। জমির জন্য উচ্চমূল্য প্রদান করা আর আজীবন একটি নির্দিষ্ট অর্থ পরিবারগুলোকে পরিশোধ করা ওই কয়লার আয় থেকেই। রাজনৈতিক বিভাজনের কারণেই বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের এই আমদানি নির্ভর বর্তমান অবস্থা।
একদিকে দেশের ৩০০ কোটি টন কয়লা মজুদ থাকার পরেও আমদানি করা কয়লা দ্বারা আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যদিকে সাগরে গ্যাস কিংবা তেল অনুসন্ধান স্তব্ধ হয়ে গেছে। তার প্রধান একটি কারণ হচ্ছে ওই বামপন্থীদের তেল-গ্যাস বন্দর রক্ষা আন্দোলন।
২০০১ এর যে সরকার ক্ষমতায় এসেছিল তাদের অদূরদর্শিতার ফলে দেশের বিদ্যুৎ খাত স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল । দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল মাত্র আনুমানিক ৪০০০ মেগাওয়াটের মতন। বর্তমান সক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নতি করা হয়েছে। কিন্তু এর প্রধান অংশই হচ্ছে আমদানি নির্ভর জ্বালানি যা আমাদের অর্থনীতি এবং জাতির জন্য মারাত্মক সংকট বয়ে আনবে আগামীতে।
পৃথিবীতে আমদানি নির্ভর জ্বালানি খাতের দেশগুলোই উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রা মান হারাচ্ছে। মুদ্রা মান সবচেয়ে বেশি হারাচ্ছে জাপান ও ইউরোপিয়ান দেশগুলো। অথচ চীন তার মুদ্রা মান ধরে রেখেছে বহুকাল যাবত বিশ্ব ব্যাংকের উপদেশ অগ্রাহ্য করে।
৯০ দশকের দিকে কিংবা তারপরে ও দীর্ঘকাল আইএমএফ চীনের মুদ্রা মান বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার উপদেশ প্রদান করত । চীন কখনো তা শুনে নাই। তাদের মুদ্রার মান ডলারের সঙ্গে একটি সুনির্দিষ্ট মান ধরে রেখেছে বহু কাল যাবত। আর বর্তমানে ধারণা করা হয় চীনের এই মুদ্রাবাদের সুনির্দিষ্ট করার ফসলই আজকের চীন।
রাশিয়ার মুদ্রার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আমাদের রাশিয়ার সঙ্গে নতুন সংকট। আমাদের রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের নিয়মিত ঋণ পরিশোধের জন্য রাশিয়ার পক্ষ থেকে রুবলে পরিশোধ করার কথা বলেছে। এরকম কোনো শর্ত আমাদের মূল চুক্তিতে নাই। কিন্তু পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়া এখন সকল আমদানি রপ্তানি রুবলে করছে। যা আমাদের জন্য খুবই কঠিন একটি ব্যবস্থা।
কারণ আমাদের দেশের পোশাক রপ্তানি প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের উপর নির্ভরশীল আমরা চাইলেই তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বহু কিছু করতে পারি না। যেমনটি এই মুহূর্তে ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে কম সাশ্রয়ী মূল্যে তেল কিনছে। চীন এই বাণিজ্যিক সুবিধা গ্রহণ করছে। চীনের সঙ্গে ব্যাপক পণ্য আমদানি রাশিয়ার থাকাতে চীনের পক্ষে রুবেলে পরিশোধ করা খুব সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের পক্ষে সেই সুবিধা গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। যদিও বেশ কিছুকাল যাবত রাশিয়া ও চীন তাদের বাণিজ্যে পারস্পরিক মুদ্রা ব্যবহার করছে।
আমাদের তেমন কোনো রপ্তানি ব্যবসা রাশিয়ার সঙ্গে নাই। রাশিয়ান ক্রুড অয়েল আমরা পরিশোধন করতে পারি না । কারণ আমাদের রিফাইনারি তৈরি করা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে তখন আমাদের নিকটতম সোর্স হিসেবে সৌদি আরব এবং ইউই এই অঞ্চলের যে লাইট ক্রড তাকে কেন্দ্র করেই তৈরী করা হয়েছিল ।
আমাদের দেশের এই রিফাইনারিটি ফ্রান্সের অর্থায়নে এবং আমাদের একটি মাত্র রিফাইনারীর উপর নির্ভর করাতে আমরা ক্রুড অয়েল থেকে উৎপাদিত অন্য অন্য প্রোডাক্ট যেমন ডিজেল, ফার্নেস, অকটেন আমদানি নির্ভর হয়ে আছি।
দেশে প্রায় ৫০ লক্ষ টন ডিজেল প্রায় ২ লক্ষ টন ফার্নেস ও এক লক্ষ ২০ হাজার টন অকটেন ব্যবহার হয় । আমাদের আরো উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন রিফাইনারি তৈরি করা হলে এই ডিজেল ফার্নেস ও অকটেন আমরাই তৈরি করতে পারতাম। হয়তো তখন আমরা রাশিয়ার ক্রুড অয়েল ব্যবহার করার সক্ষমতা অর্জন করতাম।