তৃণমূলের রাজনৈতিক অবস্থান বিজেপিকে কি আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী হতে সহয়তা করবে?

ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় লম্বা সময় দিল্লিতে থাকলেও ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন না। সে দিক বিবেচনায় ভারতীয় বাঙালিদের কাছে দিল্লির ক্ষমতার মসনদ সত্যিই অনেক দুর। স্বাধীন ভারতে বাঙালিদের কাছে দিল্লি এখনো অধরা। জ্যোতি বসুকে নিয়ে একটা সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল সত্য, কিন্তু "আমরা এখন প্রস্তুত নই" এ কথা বলে ভারতীয় কমিউনিস্টরা সেই সম্ভাবনা হত্যা করেছিল। তার খেসারত দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে। ২০২৪ পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন। তিন বছর বাকি এখনও। নুতন নির্বাচন নুতন সম্ভাবনা। এবার কী দিল্লি ধরা দিবে বাঙালিদের কাছে। ভারতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনের গুঞ্জন মমতা ব্যানার্জি এখন অনেকটা এগিয়ে।
ভারতীয় রাজনীতিতে মোদি বিরোধী অবস্থান এখন বেশ তীব্র। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি পরাজয়ের তেঁতো স্বাদ গ্রহণ করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটির হারের পরে বিজেপি বিরোধী শিবির আশার আলো দেখছে। মোদি বিরোধী সর্বদলীয় জোট নিয়ে উৎসাহিত। তৃণমূল কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধি উভয়ই জাতীয় স্তরে বিরোধী ঐক্যের প্রয়োজনের কথা বলেছেন। এখন দুটি প্রশ্ন খুব বড় হয়ে সামনে আসছে, এক. ভারতীয় জনগণ মোদির বিরুদ্ধে মনস্থির করেছে কি না এবং দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল, মোদি'র বিকল্প 'মুখ' তৈরি হয়েছে কি না। নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনও মজবুত নেতৃত্বের মুখ মানুষ অনেকদিন ধরে খুঁজছে।
কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনেক দিন ধরে চলছে। অনেক দিক বিবেচনায় সকলে মমতাকে এগিয়ে রাখছেন। তৃণমূল এখনও একটি আঞ্চলিক দল সন্দেহ নেই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বিজয়ের ইমেজ কাজে লাগিয়ে পাশের রাজ্যগুলোতেও প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান নিতে চাইছে। একই সাথে সর্বভারতীয় অবস্থান পেতে মরিয়া তৃণমূল এখন বিশেষ রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে এবারের বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে বিজেপি তৃণমূলের ঘর ভাঙতে চেয়েছিল। বাঘা বাঘা নেতারা বিজেপিতে যোগও দিয়েছিল। নির্বাচনের ফল আমরা জানি। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল এখন সুনামি'র ফিরতি টান দিচ্ছে। যারা বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন কেবল তারা নয় বরং দল ভেঙ্গে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার হিড়িক পড়েছে। ভারতের অন্যান্য প্রদেশ গোয়া, হরিয়ানা, বিহার, আসাম, উত্তর প্রদেশের পর মেঘালয়ের কংগ্রেসে ভাঙন ধরিয়েছেন মমতা। মেঘালয়ের কংগ্রেস নেতা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমার নেতৃত্বে ১২ জন কংগ্রেস বিধায়ক যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। ত্রিপুরায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, খুন ও নির্বাচনী সন্ত্রাস ও কারচুপি করে বিজেপি জয় পেলেও তৃণমূলের বিস্তার ঠেকাতে পারেনি।
ভারতের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য ত্রিপুরা। মাত্র ৪ হাজার বর্গমাইল আয়তন। জনসংখ্যা ৫০ লাখের কম। ওখানকার পৌরসভাগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো সম্প্রতি। ২৮ নভেম্বর ফল প্রকাশিত হল। মোট ৩৩৪ টির মধ্যে ৩২৯টি পেয়েছে বিজেপি। সংখ্যার বিচারে নিরঙ্কুশ। বাকিগুলোর মধ্যে সিপিএম ৩টি, তৃণমূল ১টি এবং অন্যান্য ১টি। তৃণমূল প্রথম এই রাজ্যে খাতা খুললো। এরকম বড় বিজয়ের পরও বিজেপি'র কপালের ভাঁজ দুর হচ্ছে না। আগরতলা পুরনিগমের ৫১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৬টিতে তৃণমূল দ্বিতীয়। আরো মজার ব্যাপার হল, এই পুর নির্বাচনে সিপিএম ও তুণমূলের যোগফল বিজেপি'র চেয়ে বেশি। বিজেপি'র চিন্তা এখানেই।
তৃণমূলের ঘোষিত কৌশল হল, যে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় সেখানকার প্রধান বিরোধীদের সাথে যুক্ত হয়ে বিজেপি'র বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু এই লড়া্ইয়ের অংশ যদি হয় প্রধান বিরোধী দলের ঘর ভাঙ্গা তাহলে সেখানে ভিন্ন বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসতে পারে। এই জায়গাগুলোতে ক্ষমতাসীন বিজেপি আরো শক্তি অর্জন করলো এবং জাতীয় পর্যায়ে মোদি বিরোধী যে জোট গঠনের চেষ্টা সেটা ব্যাহত হল। আসাম ও মেঘালয়ের কংগ্রেস নেতৃত্ব ও বিধায়ক তৃণমূলে যোগ দেওয়ার ঘটনা দুইদলের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা নষ্ট করবে। কংগ্রেস এখনও সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল। লোকসভার ৫৪৫ টি আসনের মধ্যে এখনও ২০০টি আসনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় কংগ্রেসের সাথে। ১৭৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আঞ্চলিক দলগুলো। কংগ্রেসের অপরিহার্যতা এখানেই। কংগ্রেস দুর্বল হলেও এখনো বড় শক্তি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তারা ১০ শতাংশ আসন পেলেও ভোট পেয়েছে ২০ শতাংশ। সরকার পরিবর্তনের অর্থপূর্ণ জোট গঠন করতে হলে কংগ্রেসকে সাথে রাখতেই হবে।
রাজনৈতিক কৌশল ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। ২০১১ এর প্রাক্কালে পশ্চিমবঙ্গে মমতার বিরুদ্ধে বিজেপি পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস দুই শক্তিকেই টার্গেট করে এগুতে থাকে তৃণমূল। কংগ্রেস ও বামফ্রন্টকে চুড়ান্ত কোণঠাসা করে ফেলে ক্ষমতাসীন তৃণমূল। রাজনৈতিক শূন্যস্থান পুরণের অবারিত সুযোগ পায় বিজেপি। ২০১১ বামফ্রন্টের পরাজয়ের পর তৃণমূল প্রাদেশিক সরকার গঠন করলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) মমতা ব্যানার্জিকে মা দুর্গার সাথে তুলনা করেছিল। এর মধ্যদিয়েই পশ্চিমবঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির এক নয়া জামানা শুরু হয়। একদিকে উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিকাশ অন্যদিকে সংখ্যালঘু মুসলিম তোষণ এই হয়ে দাঁড়ায় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির পরিণতি। এবারের বিধানসভার নির্বাচনে ভুমিধ্বস বিজয়ের কারণে অনেক দৃশ্যপটের বদল ঘটলেও পশ্চিমবঙ্গ হতে গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তির বিনাস করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক আবহাওয়া রচনার দায় কাউকে তো নিতে হবে। সুনির্দিষ্ট করে বললে, মূখ্যমন্ত্রী মমতাকে অনেক কিছু প্রমাণ করতে হবে। মোদি বিরোধী জোটের নেতৃত্বের প্রশ্নটি ইতিমধ্যে বড় হয়ে সামনে আসছে যার অর্থ দাড়াবে ২০১৯ সালের পুনরাবৃত্তি। ২০১৯ এ শেষ পর্যন্ত মোদি বিরোধী জোট হতে পারে নি।
প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও মমতার দায় রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুয়ায়ী তিস্তার পানিতে এদেশের মানুষের হিস্যা ন্যায্য। ভারত সরকার এটা মানলেও মমতার একগুয়েমির কারণে তিস্তার পানি বন্টন সম্ভব হয়নি। একতরফা পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক আইনের সৃস্পষ্ট লংঘন। ভারত সরকার বহুবার অঙ্গীকার করার পরও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। হত্যাকাণ্ডগুলো সংগঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গের কোন না কোন সীমান্তে, যার অপর প্রান্তে বাংলাদেশ। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কখনোই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছেন, এমনটি আমরা শুনিনি। এই মানবিকতাটুকুই সভ্যতা।
গত সাত বছরে মোদী সরকারের জনপ্রিয়তায় এখন ভাটার টান। অর্থনীতির ঢিমে গতির মোকাবিলায় ব্যর্থতা। হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ, প্রাদেশিক নেতাদের তীব্র সাম্প্রদায়িক ও গণবিরোধী ভূমিকা। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কোভিড মোকাবিলা, টিকার জোগানে অব্যবস্থা থেকে রুজিরুটির অভাব, পেট্রল-ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির অভিযোগ। মোদি সরকারের মৌখিক প্রতিশ্রুতির সঙ্গে কাজের ফারাক নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন। বিরোধীরা টের পাচ্ছেন, মানুষের মধ্যে অনেক অসন্তোষ। কিন্তু সেই অসন্তোষকে তাঁরা খুব যে পুঁজি করতে পেরেছেন, এমন নয়। ক্ষমতাসীনরাও হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না। প্রায় দেড়বছর ধরে চলা কৃষক আন্দোলন নিরসনের জন্য সরকারের তৎপরতা লক্ষণীয়। ড্যামেজ মেরামতের চেষ্টা!
কংগ্রেস জামানার শেষ নির্বাচনের আগে আম-জনতার মনোভাব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ৮৯ এর নির্বাচনে কংগ্রেস যে আর ফিরছে না সেটা বোঝা গিয়েছিল। ২৪ এর নির্বাচনে আম-জনতার মন-মানচিত্র কী অঙ্কন করা গিয়েছে? উত্তর না, তবে কিছু অনুমান স্পষ্ট হয়েছে। এখন অনুমানটাকে বাস্তব রূপ দিতে হলে অনেকটা পথ যেতে হবে। ত্রিপুরাতে টিএমসি এবং সিপিএম যৌথভাবে নিদেনপক্ষে সমঝোতার নির্বাচন করলেও ফল ভিন্ন হতো। লক্ষ্য যদি হয় ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ভারত তাহলে সমমনাদের ঘর ভেঙ্গে, পারস্পারিক অবিশ্বাস নিয়ে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে যে জোট গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেটি ভারতীয় জনগণের আশার আলো দেখাবে।
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে জোট গঠনের চেষ্টা আলোর মুখ দেখেনি। ভারতে '৭৭, '৮৯ এবং '৯৬ এ লোকসভা নির্বাচন জোটগত ভাবেই হয়েছিল। জোটের স্থায়ীত্ব নিয়ে মানুষ ভাবে নাই। কেবল পরিবর্তন চেয়েছিল। ২ বছর বা আড়াই বছরের বেশি কোন সরকার স্থায়ী হয়নি। কিন্তু ২০০৪ সালের সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট টানা ১০ বছর ক্ষমতায় ছিল। কোনও একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারায় ২০০৪ সালে কিছু অন্যান্য বাম-সংযুক্ত দলগুলির সমর্থন নিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস একটি সরকার গঠন করেছিল। ইউপিএ জোট প্রধান ছিলেন কংগ্রেস প্রধান সোনিয়া গান্ধি। ইউপিএ জোট তৈরি হয়েছিল নির্বাচনের পরে।