ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ায় সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউয়ের মুখে বাংলাদেশ

প্রায় সাড়ে তিন মাস পর শুক্রবার (৭ জানুয়ারি) দেশে করোনাভাইরাসের পজিটিভি শনাক্তের হার ৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। প্রতিদিনই নতুন রোগী বাড়ছে। রাজধানী ঢাকাতে করোনাভাইরাসের নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রনের গুচ্ছ সংক্রমণ চলছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে করোনা সংক্রমণের তৃতীয় তরঙ্গ শুরু হয়ে গেছে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আগামী দুই সপ্তাহ সংক্রমণ মোকাবেলায় সতর্ক না হলে এই থার্ড ওয়েভে সংক্রমণ অনেক বাড়বে বলে আশঙ্কা তাদের।
এব্যাপারে বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট ও কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পজিটিভিটি রেট ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে; তাই আমার মনে হচ্ছে দেশে কোভিডের থার্ড ওয়েভ শুরু হয়ে গেছে।
"পজিটিভিটি রেট ২ শতাংশের নিচে থেকে মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ৫ শতাংশ ছাড়াল, এবং সংক্রমণ ক্রমাগত বাড়ছে। এটি থার্ড ওয়েভের সুস্পষ্ট লক্ষণ। এখন ঢাকায় ওমিক্রনের দুই-একটি গুচ্ছ সংক্রমণ চলছে; সেটি সারা দেশে ছড়াবে কারণ মানুষ মাস্ক পরছে না। এখনই সতর্ক না হলে সংক্রমণ দ্বিগুণ হারে বাড়বে"- বলছিলেন তিনি।
আজ শুক্রবার সকাল ৮টা নাগাদ গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১ হাজার ১৪৬ জনের দেহে কোভিড সংক্রমণ ধরা পড়েছে। ফলে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে পজিটিভ শনাক্তের হার আগের দিনের ৪ দশমিক ৮৬ থেকে বেড়ে ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ হয়েছে।
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম কোভিড রোগী শনাক্ত হয় এবং ওই মাসের ১৮ তারিখে কোভিডে প্রথম মৃত্যু হয়। সংক্রমণ কমতে শুরু করে সে বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে। তবে গত বছরের মার্চের শেষে সংক্রমণ আবার বাড়তে থাকে।
এরপর ২০২১ সালের জুলাই-আগস্ট ডেল্টা ভেরিয়েন্টের প্রভাবে দ্বিতীয় তরঙ্গ ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। ২৫ জুলাই থেকে ১৩ আগস্ট টানা ১৯ দিন দুইশ'র বেশি মৃত্যু হয়েছে। দৈনিক রোগী শনাক্ত ১৬ হাজার ছাড়িয়ে যায়। হাসপাতালগুলো রোগীর চাপে রোগী ভর্তি নেয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। অক্সিজেনের অভাবে রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে সেকেন্ড ওয়েভ চলাকালে।
বাংলাদেশ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ডা. মোহাম্মদ মুশতাক হোসেন টিবিএসকে বলেন, "সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় মনে হচ্ছে দেশে করোনাভাইরাসের থার্ড ওয়েব শুরু হতে যাচ্ছে। আগামী দুই সপ্তাহ যদি সংক্রমণ বৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকে, তবে থার্ড ওয়েভ শুরু হয়েছে বলা যাবে। যদিও সংক্রমণের গ্রাফ অনুযায়ী আমি এটাকে ফোর্থ ওয়েভ মনে করি। ভারতে ওমিক্রনের প্রভাবে সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এর প্রভাব আমাদের দেশে পড়বে জানুয়ারির শেষে বা ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে। এর আগেও ডেল্টা ভেরিয়েন্টের সময় কলকাতায় সংক্রমণ বৃদ্ধির এক মাস পর বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় সংক্রমণ অনেক বেড়েছিল।"
তিনি আরও বলেন, এখন ওমিক্রনের সব রোগী ঢাকার; যারা ইউরোপ-আমেরিকা থেকে এসেছে বা তাদের সংস্পর্শে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছে। ওমিক্রনের এই গুচ্ছ সংক্রমণ কিছুদিন পর কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হবে। তখন দুই তিন দিনের ব্যবধানে রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বাড়বে। এখনই ভাইরাসের ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে হবে, তা না হলে রোগীর চাপ অনেক বেড়ে যাবে।
গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ড. তেদরোস আধানম ঘেব্রেয়াসুস বলেছেন, 'দেখা গেছে ডেল্টার তুলনায় ওমিক্রনের প্রভাব কম মারাত্মক হয়েছে। বিশেষ করে যারা টিকা নিয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে এর সংক্রমণ মারাত্মক হয়নি। কিন্তু তাই বলে ওমিক্রনকে কম মারাত্মক ভাবার সুযোগ নেই'- বলে সতর্ক করেন তিনি।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ২০ জন ওমিক্রন ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে, তাদের সবাই ঢাকার বাসিন্দা। দেশে এখনো ওমিক্রন ভেরিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ না হলেও, সরকার এরইমধ্যে সংক্রমণ মোকাবেলায় ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এবিএম খুরশীদ আলম টিবিএসকে বলেন, "ওমিক্রন মোকাবেলায় যে নির্দেশনাগুলো আছে সেগুলো বাস্তবায়নে এখন আমরা কাজ করছি। আমাদের সক্ষমতা ও প্রস্তুতি বাড়ানো হচ্ছে। হাসপাতাল ব্যবস্থাকে আবারো কোভিড রোগীদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। টার্গেট অনুযায়ী অধিকাংশ হাসপাতালে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ও আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছে। বাকিগুলোর কাজও দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।"
সংক্রমণ বাড়ার আগেই মহামারির প্রক্ষেপণ মেনে সরকারের ১৫ দফা নির্দেশনা সময়োপযোগী বলে মন্তব্য করেছেন মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, এখন এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কোভিড প্রতিরোধ কমিটি জনগণকে সম্পৃক্ত করতে কাজ করলেও ঢাকা শহর যেন নো ম্যানস ল্যান্ড। এখানে মেয়রদের নেতৃত্বে কোভিডে প্রতিরোধ কমিটিকে সক্রিয় করে মানুষকে মাস্ক পরা, দূরত্ব মানা, ভ্যাকসিন নিতে উদ্বুদ্ধ করা গেলে থার্ড ওয়েভে সংক্রমণ ও মৃত্যু কম হবে।