দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সংযোগ স্থাপনে নির্মিত হবে বিকল্প মেঘনা সেতু

পদ্মা সেতুর ওপর দ্বিতীয় আরেকটি সেতু নির্মাণের বদলে মেঘনা নদীতে শরীয়তপুর ও চাঁদপুর সংযোগ করে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেতুটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলকে সংযুক্ত করবে।
সেতু বিভাগের এক সূত্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছে, মার্চে এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পরামর্শদাতার নাম ঘোষণার পরিকল্পনা করছিল সরকার। নিয়োগ দেওয়ার পরই নিয়োগপ্রাপ্ত পরামর্শদাতা দুই বছরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিবেন।
প্রাথমিক ভাবে মানিকগঞ্জ-রাজবাড়ির পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পয়েন্টে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করে সরকার।
তবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ঢাকার মানুষের জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্পের সুবিধা বিবেচনা করে ঢাকার ওপর চাপ কমিয়ে সরাসরি বরিশাল ও খুলনার মতো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে চট্টগ্রাম বা সিলেটের সংযোগ স্থাপনের কথা চিন্তা করে সরকার।
সেতু বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো: ফেরদাউস বলেন, প্রথমের সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল, মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণের অভিজ্ঞতার আলোকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে পাটুরিয়া- দৌলদিয়ায় দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে।
সে অনুযায়ী পিপিপি বোর্ড এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সম্প্রতি এ সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
"একই সঙ্গে চাঁদপুর-শরিয়াতপুর পয়েন্টে মেঘনা নদীর ওপর এ সেতু নির্মাণ করার কথা ভাবছে সরকার। ধারণা করা হচ্ছে, চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে সেতু নির্মাণ হলে অর্থনৈতিকভাবে তা আরও বেশি লাভজনক হবে। "
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সেতু বিভাগ সারা দেশে বড় বড় নদীর ওপর সেতু নির্মাণের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে।আপতত স্থগিত থাকলেও পাটুরিয়া –দৌলদিয়া পয়েন্টে পদ্মা সেতু কবে নির্মাণ করা হবে তা মহপরিকল্পনায় উল্লেখ থাকবে।
বর্তমানে অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিচেনায় সরকার চাঁদপুর-শরিয়াতপুর পয়েন্টে মেঘনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার।
২০১৯ সালে চাঁদপুর-শরিয়াতপুর পয়েন্টে মেঘনা সেতু নির্মাণ এবং সেতু বিভাগের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে আন্তর্জাতিক পরামর্শক নিয়োগে দরপত্র আহ্বান করে সেতু বিভাগ। গত বছরের জানুয়ারিতে দরপত্র জমা দেওয়ার সময় নির্ধারিত থাকলেও কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এ কাজে এক বছরের বেশি সময় বিলম্বিত হয়েছে।
তবে চলতি মাসে দরপত্র প্রক্রিয়া অনুযায়ী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করা হয়েছে। শীঘ্রই আনুষ্ঠানিকভাবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রকাশ করা হবে। এর পরই অনুমোদনের জন্য ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা পরিষদের সভায় পাঠানো হবে এ ক্রয় প্রস্তাব।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন সম্ভাব্যতা নিরূপণের সমীক্ষার পরই সেতুর দৈর্ঘ্য ও প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের হিসাব জানা যাবে।
সেতু বিভাগের সচিব বেলায়েত হোসেন বলেন, মেঘনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত হয়েছে। সব প্রক্রিয়া শেষ করে আগামী জুনে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সমীক্ষার কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। দুই বছরের মধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে।
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর জন্য প্রায় ১০ বছর আগে একটি সমীক্ষা হয়েছিল। সবচেয়ে কম খরচে এ সেতু নির্মাণের বিষয়টি বিবেচনায় ছিল তখন।
"কিন্ত যে রুটে বেশি লাভবান হওয়া যাবে সে রুটেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করার কৌশল নেওয়া হয়েছে। সে হিসেবে চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে এ সেতু নির্মাণ করা ভালো উদ্যোগ হবে। তবে সব কিছু চূড়ান্ত হতে হবে সমীক্ষা মাধ্যমে।"
প্রস্তাবিত এ সেতুতে সড়কের পাশাপাশি রেল সংযোগ রাখারও পরামর্শ দেন এ বিশেষজ্ঞ ।
সেতু বিভাগের কর্তকর্তারা জানান, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন চূড়ান্ত হওয়ার পর অর্থায়নের বিষয়ে নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। এটি পিপিপি'র মাধ্যমে হবে নাকি উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে হবে, তখন সিন্ধান্ত নিতে সরকারের পক্ষে সহজ হবে।
এদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমান পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি বাতিল করায় জটিলতার সৃষ্টি হয়।
পরবর্তী সময়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান সরকারের আন্তজার্তিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা (জাইকা) এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকও (আইডিবি) অর্থায়ন থেকে সড়ে দাঁড়ায় ।
তবে এবার বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে দ্বিতীয় পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মাওয়া দিয়ে পদ্মা সেতু চালু হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে চলাচলকারী যানের কারণে পদ্মা সেতুর ওপর চাপ বাড়বে।
অন্য দিকে চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে সেতু নির্মাণ করা হলে এ চাপ এড়ানো সম্ভব হবে। ফলে অর্থ, সময় ও জ্বালানী অপচয় অনেক কমে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন খুলনা থেকে কোনো গাড়ি চট্টগ্রাম যেতে হলে ঢাকা ওপর দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে সেতু নির্মাণ হলে খুলনা থেকে চট্টগ্রামগামী গাড়িকে ঢাকা হয়ে যেতে হবে না। এতে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ কমে যাবে।
দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১১ টি জেলার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ টি জেলাকে যুক্ত করবে পদ্মা-মেঘনা সেতু। দেশের দক্ষিণ- পূর্বাঞ্চলে রয়েছে বাণিজ্যক রাজধানী চট্টগ্রাম, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর এবং পর্যটন নগরী কক্সবাজার ও পার্বত্য জেলা- রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে রয়েছে মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দর।
এ দুই অঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ বাড়লে অর্থনৈতিক গতিশীলতা আরও বৃদ্ধি পাবে। এ সংযোগের কারণে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সঙ্গেও ব্যবসা- বাণিজ্য বাড়বে বলে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, পদ্মা বা মেঘনা নদী দেশের দুটি অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। দুই অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা গেলে অর্থনৈতিক সংযোগও তৈরি হবে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে , কমবে দারিদ্র্য,"
"এছাড়া চাঁদপুর –শরিয়তপুর দিয়ে সেতু নির্মাণ করা হলে ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমবে। এতে ঢাকা কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও গতি হারাবে না। সবচেয়ে বড় কথা এ রুটের কারণে আঞ্চলিক সংযোগ সম্প্রসারণ হবে। প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যও সম্প্রসারণ হবে।" যোগ করেন তিনি।