জেলে বসেই আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ক্যাসিনো খালেদের

প্রায় তিন মাস আগে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের সময় গ্রেপ্তার হয় খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। ওই সময় তার ধারণা ছিল, দ্রুত জামিনে মুক্ত হবে সে। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে সহজে তার মুক্তি মিলছে না। আর তাই এখন জেলে বসেই সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা তার।
জেলে বসেই সহযোগীদের নির্দেশনা দিয়ে সে বলেছে, রামপুরা, খিলগাঁও, সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিল এবং রমনা এলাকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী মানিকের সঙ্গে যেন তারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখে।
দীর্ঘদিন ধরে মজুদ করা আগ্নেয়াস্ত্র যেন খোয়া না যায় সে বিষয়ে ঘনিষ্ঠদের নির্দেশনা দিচ্ছে সে।
জেলে বসেই অবৈধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করছে খালেদ। র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করলেও খালেদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আন্ডারওয়ার্ল্ডের ১৫ সহযোগীর হাতে রয়েছে সব আগ্নেয়াস্ত্র। যারা রাজধানীর আলোচিত সব হত্যা মামলার আসামি। তাদের মাধ্যমেই খালেদ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এখন ঘনিষ্ঠ সহযোগী মানিককে দিয়ে জেলে বসেই রামপুরা, খিলগাঁও, সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিল, রমনাসহ আশেপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে খালেদ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদের ১৫ ক্যাডারের হাতে রয়েছে শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র। এর মধ্যে ৪টি অত্যাধুনিক অস্ত্র একে-২২এস।
অধিকাংশ অস্ত্রই চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বাবর চট্টগ্রামে জোড়া খুনসহ ১৬টি মামলার আসামি। চট্টগ্রাম থেকে অস্ত্রের চালান আসত ট্রেনে।
বাবরের বন্ধুর পল্টনের একটি অস্ত্রের দোকান থেকেও খালেদের কাছে অস্ত্র যেত। অস্ত্র মজুদ করা হতো ঢাকার শান্তিনগরের চামেলীবাগের একটি বাসা এবং কমলাপুরের একটি বাসায়।
চামেলীবাগের বাসাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক জনপ্রতিনিধির। আর কমলাপুরের বাসাটির মালিক একজন চিকিৎসক। তারা দুজনেই খালেদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, খালেদের ঘনিষ্ঠ একাধিক সহযোগীর জবানবন্দি এবং অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। প্রায় তিন মাস আগে খালেদ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হলেও তার অস্ত্রধারী ক্যাডারদের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। তার বিশাল অস্ত্রভান্ডার এখনও অক্ষত আছে।
খালেদের সহযোগীরা:
দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, খালেদের প্রধান সহযোগীর নাম বেলাল হোসেন কিসলু ও রইছ উদ্দিন। মিথুন এবং টিটু খুনের অন্যতম আসামি তারা।
দুটি হত্যাকাণ্ডই ঘটে ২০০৫ সালে বনশ্রীর ক্রিস্টাল ক্যাবল নেটওয়ার্কের অফিসে। রনি ও সজিব নামের দুই ভাড়াটে কিলারও এই জোড়া হত্যা মামলার আসামি।
ক্যাবল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২০১৪ সালে মগবাজারে মাহবুবুর রহমান রানা হত্যার সঙ্গে জড়িত রইছ, রনি এবং সজিব। খালেদের আরেক সহযোগী ফখরুলও এই রানা হত্যায় জড়িত।
শাহাদাত হোসেন সাধু, রাসেল এবং সোহাগ নামে আরও তিন ভাড়াটে কিলার খালেদের দলে যোগ দিয়ে নগরীর ত্রাস হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এদিকে ২০১৩ সালে আলোচিত যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কী হত্যা মামলার তিন আসামিকে পুনবার্সিত করেছে খালেদ। এই তিনজন হলো- কাইল্যা আমিনুল, অঙ্কুর ও উজ্জল মোর্শেদ। তাদের কাছেও খালেদের অনেক অস্ত্র রয়েছে।
২০১০ সালে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ নেতা ডা. নিতাই হত্যা মামলার দুই আসামি কবির এবং পারভেজকে দলে ভিড়িয়েছে খালেদ।
কবিরের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে।
খালেদের আরেক সহযোগী পল্টি রিপন ২০০৭ সালে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কাওছার হত্যা মামলার আসামি।
আরেক সহযোগী সেলিম মহাখালীতে আওয়ামী লীগ নেতা সিদ্দিক হত্যা মামলার আসামি।
খালেদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অস্ত্র মামলার তদন্ত করে র্যাব বলেছে, খালেদ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের পদ পেয়ে এলাকায় বিশাল এক সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলে। অস্ত্রধারী এই বাহিনীর মাধ্যমেই সে অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতো।
ঢাকার মতিঝিল, আরামবাগ, ফকিরাপুল, শাহজাহানপুর, মুগদা, কমলাপুর, রামপুরা, সবুজবাগসহ আশেপাশের এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। র্যাবের তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এলেও এখন পর্যন্ত খালেদের সন্ত্রাসী বাহিনীর কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় নি।
র্যাব-৩ এর অধিনায়ক শাফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, খালেদের বিরুদ্ধে উঠা বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত চলছে। অস্ত্র মামলায় এরই মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। তার সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছে।
ঢাকায় যেভাবে অস্ত্র ও ইয়াবা আসতো:
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পাওয়ার পর রেলভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় খালেদ। সেখানে তার দুই ভাই টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতো। সব টেন্ডারেই তাদের ভাগ থাকতো ৪ শতাংশ হারে।
ট্রেনের ক্যাটারিং এবং ক্লিনিংয়ের টেন্ডারও ভাগিয়ে নিতো খালেদের সিন্ডিকেট। ট্রেনের ক্যাটারিং এবং ক্লিনিয়ের দায়িত্বে খালেদের ঘনিষ্ঠরাই থাকতো। এর আড়ালেই চট্টগ্রাম থেকে বাবরের মাধ্যমে অস্ত্র ও ইয়াবার চালান আসতো। অস্ত্রের চালান রিসিভ করতো কিসলু। আর ইয়াবার চালান রিসিভ করতো সোহাগ।
খালেদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত সোহরাওয়ার্দী জানান, বাবরের মাধ্যমে খালেদ অস্ত্র সংগ্রহ করত। বায়তুল মোকাররম মসজিদের উল্টোপাশে পল্টনে বাবরের এক বন্ধুর একটি বৈধ অস্ত্রের দোকান আছে। বৈধ অস্ত্রের আড়ালে সেখানেও চলে অবৈধ অস্ত্রের কারবার। বাবর তার কাছ থেকেও অস্ত্র নিয়ে খালেদকে দিয়েছে।
জেলে বসে যেভাবে নির্দেশনা দেয় খালেদ:
ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, কেরানিগঞ্জ জেলে দেখা করতে আসা আত্মীয় বা সহযোগীদের মাধ্যমে নির্দেশনা দিত খালেদ।
যদিও কেরানিগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের এক প্রহরীর কাছ থেকে জানা গেছে, খালেদকে ইতোমধ্যে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।