গুজবের ভূমিকম্প, আশ্চর্য নবজাতক ও রাতভর তুলকালাম

'সুনামগঞ্জের ছাতকে একটা শিশুর জন্ম হয়েছে। জন্মের পরপরই নবজাতক কথা বলতে পারছে ও করোনা ভাইরাস থেকে প্রতিকারের উপায় বলে দিচ্ছে।'-- বৃহস্পতিবার রাতে ফোন করে এমনটি জানালেন একজন। সঙ্গে ওই নবজাতকের মায়ের মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে আলাপ করে নিতেও বললেন।
কলদাতার দেওয়া মোবাইল নম্বরে কল দিয়ে জানা গেল, ওই নারীর বাড়ি ছাতকে নয়, সিলেট শহরেই। তিনি সর্বশেষ সন্তান জন্ম দিয়েছেন প্রায় এক যুগ আগে।
এরপর থেকে এমন সংবাদ আসতেই থাকল। শুধু একেকজন সংবাদদাতার মুখে নবজাতকের জন্মস্থানটা বদলে গেল। একজন বলেন কুলাউড়ায়, তো আরেকজন বলেন- না না, ফেঞ্চুগঞ্জে।
বৃহস্পতিবার রাতে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে সিলেটজুড়ে। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ওই নবজাতক ভূমিষ্ট হয়েই 'চিনি ছাড়া লাল চা খাওয়ার' পরামর্শ দিয়েছে-- এমনটিও ছড়াতে থাকেন কেউ কেউ। মুহূর্তেই ফেসবুক ছেয়ে যায় এইসব অদ্ভূত গুজব আর আশ্চর্য নবজাতকের তথ্যে।
মধ্যরাত পর্যন্ত স্থায়ী ছিল এই নবজাতকের গুজব। মধ্যরাত পেরোনোর পর বদলে যায় গুজবের ধরণ। তখন সিলেটেজুড়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, শুক্রবার ভোরের দিকে বিরাট ভূমিকম্প হবে। এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে বাতাসের বেগে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে তা আরও গতি পায়।
এমননিতেই ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল সিলেট। তারপর বৃহস্পতিবার থেকে প্রায় লকডাউন পুরো বিভাগ। সব জায়গায় সুনসান নীরবতা। এমন ভূতুড়ে পরিবেশে ডালপালা মেলতে থাকে গুজব।
এই খবর কোথাও থেকে এলো-- জানে না কেউ, খবরের সত্য-মিথ্যা যাচাইয়েও আগ্রহ নেই কারও; তবু গুজবের ভূমিকম্পের খবরে ঘুম থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মানুষ। মধ্যরাতে মসজিদে মসজিদে শুরু হয় আজান। হিন্দুদের ঘর থেকে ভেসে আসে উলুধ্বনি। বাড়ির তুলসি গাছের তলায় গিয়ে প্রদীপ জ্বালান কেউ কেউ। আল্লাহ আকবর স্লোগান দিয়ে মিছিলও হয় অনেক জায়গায়। গুজবের শক্তির কাছে হেরে যায় সামাজিক দূরত্ব বজায়ের নির্দেশনা আর রাতের নিস্তব্দতা। কোনো কোনো এলাকার মসজিদ থেকে এলাকাবাসীকে মধ্যরাতে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়।
যদিও শুক্রবার ভোরে সিলেটে কোনো ভূমিকম্প হয়নি। আর দিনভর খুঁজেও জন্মের পরই কথা বলতে পারে-- এমন কোনো নবজাতকের সন্ধান মেলেনি।
সিলেট সদরের কান্দিগাও মসজিদে আজান দেওয়া হয় বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে। হঠাৎ আজান দেওয়া প্রসঙ্গে এই মসজিদের মোয়াজ্জিন মাওলানা আশরাফ হোসেন বলেন, যেকোনো বিপদেই আজান দেওয়ার কথা ইসলামে বলা আছে। শুনেছি ভূমিকম্প হতে পারে। সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে আজান দেওয়ায় তো কোনো ক্ষতি নেই।
হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার বিভিন্ন মসজিদের মাইকে 'এলাকাবাসী আপনারা ওঠেন, রাত দুইটায় ভূমিকম্প হবে' বলে প্রচার করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হয় আজান। আজানের পর 'আল্লাহু আকবর' স্লোগানে মিছিল শুরু করে এলাকাবাসী।
উপজেলার শাহজাহানপুর ইউনিয়নের সুরমা গ্রামের শাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, মধ্যরাতে মানুষের ঘুম নষ্ট করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা-- এটা কেমন কথা? আমরা নিজ উদ্যোগে কয়েকটি মসজিদ কমিটিকে বলে গুজব বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছি।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক কাজী এম. এমদাদুল ইসলাম বলেন, এমন গুজব ছড়ানোর পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এই মহামারির সময়ে মানুষের মনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তারা বিভ্রান্ত করতে চায়। গুজব যারা ছড়িয়েছে, আমরা তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।
তিনি সাধারণ মানুষদের গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানান।
গুজব রটানাকারীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের সিলেট রেঞ্জের উপ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) কামরুল আহসান। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষকেও এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। কানকথা বা ফেসবুকের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে সরকারের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। কোনো বিষয়ে প্রশ্ন থাকলে প্রশাসনের সহযোগিতা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।