পটল তোলা! এলো কী করে?

উত্তর বঙ্গের এজিল মহকুমা প্রশাসক তেলের শিশি নিয়ে কবিতা লিখে কাবু করলেন কিন্তু পটল নিয়ে লিখে একটা ঝামেলা পাকিয়ে ফেললেন। তেলের শিশি ভেঙ্গেছে বলে খুকুকে বকাঝকা খেতে হলো কিন্তু বুড়ো ছেলেরা যে দেশ ভেঙ্গে ফেললো তার বেলা? সেই শিশি বোতলের কবি অন্নদাশঙ্কর রায় পটলের কবি হতে গেলেন, লিখলেন :
পটল নামে লোক ভালো
পটল চেরা চোখ ভালো
পটল খেতে ভালো যে
কিন্তু পটল তুলবে কে
গন্ডগোল শুরু হয়ে গেল, তিনি বাঙালি জাতির সামনে ভয়ঙ্কর এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন, পটল তুলতে রাজি এমন কোনো বাঙালি হাসিমুখে এগিয়ে এলেন না। বললেন না , আমি তো আছি চিন্তা কী? পটল আমিই তুলব। পটলকাব্য লেখার পর তিন যুগ অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর অন্নদাশঙ্কর রায় নিজেই পটল তুললেন।
তারও ঢের আগে পটলপ্রিয় সুকুমার রায় খুব করে পটলযুক্ত খাবারের বিজ্ঞাপন দিলেন:
পোলাও ভালো কোর্মা ভালো,
মাছ-পটোলের দোলমা ভালো…
ঠেলার গাড়ী ঠেলতে ভালো,
খাস্তা লুচি বেলতে ভালো
উপেন্দ্রকিশোরের ছেলে বলে সুকুমার রায় এমনিতেই যথেষ্ট সেয়ানা, তার ছড়াতে পটল তোলার মতো অপছন্দের কোনো কাজ চাপিয়ে দেয়া হয়নি, এমনকি প্রসঙ্গটি তোলেনও নি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনীতে সত্যজিৎ রায়ের অশনী সংকেতে এগারো বছর বয়সী ছেলে পটলের কথা মনে নেই? বিভূতিবাবু অন্যদের দিয়ে এই বালকটিকে পটল ভাজিয়েছেন, এমনকি গাট্টাগোট্টা কাউকেও বলেননি পটলকে একটু তোলো।
পটল একটু তোলা আর পুরোটা তোলার পরিণতি একই, পটল হালকা হলেও যা ভারী হলেও তা। গাঢ় সবুজ হলে যা পাকা হলদে রঙ ধরলেও তা। পটল পটল-ই। আজকাল অবশ্য কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন ডিজিটাল পটলে ঝুঁকি নেই। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করে ঠকতে রাজি নই। সুকুমার রায়ও পটল তুলেছেন। ২০১৭ সালের হিসেবে প্রতি ২৪ ঘন্টায় পৃথিবীর দেড় লাখ লোক পটল তোলেন। করোনাভাইরাস এসে সমস্যাটা বাড়িয়ে দিয়েছে। এক বছর আগেও কেউ পটল তুললেও তাকে নিয়ে কুলখানি হতো, চল্লিশা হতো। কিন্তু করোনা সংক্রমণের ভয়ে কুলখানি আর চল্লিশা এখন তেমন হয়না।
আপনি পটল ভাজা খাবেন, পটলের দোলমা, ডালমা, কীমা, আলু-পটল, দই-পটল, সর্ষে পটল সবই খাবেন কিন্তু পটল তুলতে যাবেন না, তা হয় না।
হজম বলুন, রক্তশোধন, কোলেস্টেরল হ্রাস, কৌষ্ঠকাঠিন্য নিরসন বলুন পটলই উত্তম। কিন্তু পটল তো গাছ থেকে নিউটনের আপেলের মতো পড়ে না, কিংবা মিশেল ফুকোর পেন্ডুলামের মতো দুলবে না যে খপ করে ধরে ফেলবেন। পটল খাওয়ার জন্য তুলতে হবে। কিন্তু তুলতেও আপত্তি, অন্যের তোলা পটলেই ভরসা। কাদম্বরী দেবীর তোলা পটল খেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সারদাসুন্দরী দেবীর তোলা পটল খেয়েছেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর দিগম্বরী দেবীর তোলা পটল খেয়েছেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। নিজের তোলা পটল খাওয়ার ভাগ্য আগে হতো না, এখন কি হয়?
দিন পাল্টেছে, খবর পড়েছেন নিশ্চয়ই কুষ্টিয়ার কৃষক জাহাঙ্গীর পতিত জমিতে পটল চাষ করে আজ লাখপতি! তিনি পটল তোলার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, আরও অনেকেই হয়তো স্বাবলম্বী ও লাখপতি হতে পটল তুলতে শুরু করেছেন।
পটল আর পটলচেরা যতো লোভনীয়-ই হোক সংসদ বাংলা অভিধান বলছে পটল তলা মানে মারা যাওয়া। বাংলা একাডেমীর বাংলা থেকে ইংরেজি অভিধানে পটল তোলা মানে আছে Die, Kick the bucket, Croak- সবগুলোর অর্থই মারা যাওয়া। কোনো গাছের সবগুলো পটল তুলে ফেললে গাছটি মারা যায়, সে থেকেই এই বাগধারার প্রবর্তন।
আরও আছে; চোখের অপর নাম অক্ষিপটল - মৃত্যু হলে চোখ বা অক্ষিপটল উপরের দিকে উল্টে যায়; তাই পটল তোলা দ্বারা মৃত্যুকে বুঝায়। মৃত ব্যক্তির পট বা পরিধেয় বস্ত্র তুলে রাখতে হয়; সেই পট তোলা কালক্রমে পটল তোলা হয়েছে