ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস

মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা তাসলিমার স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে বছর দুয়েক আগে। যেভাবে নিজের দেহে ক্যান্সারের কথা জানতে পান তিনি সেই বিবরণ শোনা যাক তাঁর নিজেরই বর্ণনায়:
“এপ্রিল মাসের এক সন্ধ্যার কথা। ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছি। কদিন ধরেই গায়ে জ্বর। ওজনও কেবল কমে যাচ্ছিল। কিন্তু কখনও কল্পনাও করিনি যে, এসব স্তন ক্যান্সারের লক্ষ্মণ হতে পারে।”
এর আগে তাসলিমার পরিবারে বা আত্মীয়দের কারও কিংবা পড়শিদের মধ্যেও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার কথা শুনতে পাননি তাসলিমা। তাই তাঁর ক্যান্সোর-আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে পুরো পরিবার অসহায় বোধ করতে লাগল। ক্যান্সার-আক্রান্ত রোগীকে কীভাবে দেখাশুনা করতে হয়, সেটাও পরিবারের কেউ জানতেন না তখন।
সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রোগ ধরা পড়লে সপ্তাহ খানেক তাদের পরিবারে কিছুই স্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু তাসলিমা বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। তাই চিকিৎসা নেওয়া শুরু করলেন। প্রথমেই অপারেশন করে তাঁর ডান স্তনটি সরিয়ে দেওয়া হল। এরপর শুরু হল কেমোথেরাপি।
“মনে হল যেন যুদ্ধ করছি,’’ বললেন তাসলিমা। এখন তাঁর কেমোথেরাপির অষ্টম সেশন চলছে। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটালের ক্যান্সার ইউনিটে কথা হল তাঁর সঙ্গে।
প্রত্যেকবার কেমো নেওয়ার পর তাঁর শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেয়। দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি। বমি হয়। আরও নানা ধরনের সমস্যা তো আছেই। এজন্য এ সময় আর কিছু করতে পারেন না তাসলিমা।
পাঁচ সন্তানের মা চল্লিশোর্ধ্ব তাসলিমার বড় দুই ছেলে তাঁর চিকিৎসার খরচ জোগাচ্ছেন। এ যাবত ওরা প্রায় ৭ লাখ টাকা খরচ করেছেন মায়ের চিকিৎসার জন্য।
ক্যান্সারের রোগীর শারীরিক সমস্যা এবং তাঁর পরিবারের আর্থিক ক্ষতির বিষয়গুলোর সঙ্গে যেটি অনিবার্য তা হল, মানসিক অবস্থার পরিবর্তন। তাসলিমা ডিপ্রেশনে ভোগেন। কেমোর প্রভাবে মাথার সব চুল পড়ে যাওয়ার বিষয়টি তিনি মেনে নিতে পারেন না। তাছাড়া স্থায়ীভাবে রোগমুক্তি ঘটবে কি না তা-ও জানেন না তিনি। এসবই তাঁকে হতাশ করে।
আঞ্জুমান আরা বেগমের স্তন ক্যান্সার ধরা পড়েছে দশ বছর আগে। ২০০৯ সাল থেকে এমআরআই, সিটি, পিইটি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি-- এসবইএখন তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোনো স্বাভাবিকতা নেই তাদের পরিবারে।
নীলফামারীর জলঢাকায় থাকেন পঞ্চাশের কোঠায় বয়সী এই নারী। কিন্তু চিকিৎসার জন্য নিয়মিত আসেন ঢাকায়। ক্যান্সারের চিকিৎসা করতে করতে তাঁর দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাটিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই মাঝে মাঝে ভীষণ অসুস্থ বোধ করেন। গত মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন আঞ্জুমান আরা। চিকিৎসার এক পর্যায়ে তাঁর অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠেছিল।
তিন কন্যা ও এক পুত্রের মা আঞ্জুমান চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এলে রাজধানীর আগারগাঁওতে বড় মেয়ের বাসায় ওঠেন। তাঁর স্বামী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, গত দশ বছরে তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য খরচ হয়েছে প্রায়ং ১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশে নারীদের এক নম্বর প্রাণঘাতী ক্যান্সার হল স্তন ক্যান্সার। গ্লোবোকন ও ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ এন্ড ক্যান্সার (আইএআরসি) জানিয়েছে, বাংলাদেশে ফি বছর ১২ হাজার ৭০০ নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। আর বাংলাদেশের ক্যান্সার-আক্রান্ত নারীদের ১৯ শতাংশ আক্রান্ত হন স্তন ক্যান্সারে।
প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করা গেলে সুস্থ হয়ে যাবার ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের সম্ভাবনা বাড়ে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার মহামারী বিভাগের প্রধান ড. হাবীবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।
তবে এরপরও রোগীকে নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ফলোআপ করতে হবে।
ড. হাবীবুল্লাহ অবশ্য মনে করেন, স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রতিরোধই সবচেয়ে ভালো উপায়। শিশু মায়ের দুধ পান করলে মা অনেকটা নিরাপদ থাকেন। এটি একই সঙ্গে মা ও শিশু দুজনের জন্য উপকারী বলে জানান তিনি।
মায়েদের তাদের সন্তানদের বুকের দুধ পান করানোর বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে প্রচারাভিযান চালানোর জন্য পরামর্শ দিলেন এই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ।
ক্যান্সারজয়ের গল্পগুলো
২০০৩ সালের দিকে রাতের বেলা প্রায়ই জ্বর আসত তাহমিনা গাফফারের। ওজনও আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছিল তাঁর। চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি মেমোগ্রাফি করানোর পরামর্শ দিলেন। স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য মেমোগ্রাফির দরকার হয়।
পরীক্ষায় তাঁর ডান স্তনে একটা চাকার অস্তিত্ব ধরা পড়ল। চিকিৎসকরা তখন তাঁর বায়োপসি করতে বললেন। এরপর তাঁর স্তনে ক্যান্সারের অস্তিত্ব ধরা পড়ল।
এবার শুরু হল তাহমিনার যুদ্ধ। প্রথম যখন ক্যান্সারের কথা জানতে পারলেন, ভেবেছিলেন শিগগির মারা যাবেন।
“ওই সময়ে ক্যান্সার মানেই ছিল নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু আমি হাল ছাড়তে চাইনি। সেজন্য চিকিৎসা করাতে মুম্বাইতে চলে গেলাম। চিকিৎসকরা আক্রান্ত স্তনটি সরিয়ে ফেললেন। এরপর শুরু হল কেমোথেরাপি”, জানালেন তাহমিনা।

ভারতে প্রথম কেমোথেরাপির পর বাংলাদেশে আরও পাঁচ বার এই চিকিৎসা নিতে হয়েছে তাঁকে। যন্ত্রণাদায়ক চিকিৎসাটি নিতে গিয়ে তাঁর মাথার চুল ও ভ্রু ঝরে গেছে। প্রথম দিকে তাঁর নাতি তাঁকে চিনতে পারত না। বিষয়টি খুব কষ্ট দিয়েছে তাহমিনাকে।
এজন্যই তাহমিনা মনে করেন, ক্যান্সারের লড়াইতে টিকে গেলেও শারীরিক যন্ত্রণাগুলোর চেয়ে একসময় সামাজিক সমস্যাগুলো বড় হয়ে ওঠে।
সেই ষোল বছর আগে ক্যান্সারকে সংক্রামক ব্যাধি বলেও মনে করা হোত, জানালেন তাহমিনা।
“কেউ আমাদের বাসায় আসত না। আমাদের ঘরে আত্মীয়রা কিছু খেত না। তাই কারও বাসায় বেড়াতে গেলে আমিও তাদের চামচ বা বাটি ব্যবহার করতাম না। কারণ আমি জানতাম, আমি চলে গেলে ওরা সেসব ফেলে দেবে।”
এসব কষ্টের ভাগ নেবার কেউ ছিল না তখন তাহমিনার পাশে।
এমনকি এটাও অনেকে বলাবলি করতেন যে, তিনি ক্যান্সার আক্রান্ত বলে তাঁর ছেলের বিয়েতে সমস্যা হবে। এটা ছিল তাহমিনার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্টের বিষয়।
পাঁচ বছর টানা চিকিৎসার পর এখন চূড়ান্তভাবে ক্যান্সারকে পরাজিত করেছেন চৌষট্টি বছরের তাহমিনা। ক্যান্সারজয়ীদের (ক্যান্সার সারভাইভার) সংগঠন ‘অপরাজিতা সোসাইটি এগেইনস্ট ক্যান্সার’-এর জন্য কাজ করছেন তিনি।
একদম শুরুতেই তাঁর ক্যান্সার ধরা পড়েছিল এবং চিকিৎসাও দ্রুত নিতে শুরু করেছিলেন বলে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হতে পেরেছেন। এখন রোজ ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম করেন। আর বছরে একবার স্তনের রুটিন চেকআপ করান।
“অপরাজিতা সোসাইটি আমার জীবনে আনন্দ ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি গান শুনি, কবিতা পড়ি। মানুষকে ক্যান্সারের বিষয়ে সচেতন করতে কাজ করি”— জানালেন তাহমিনা।
অক্টোবর মাস হচ্ছে ‘স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস’। ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে ১০ অক্টোবর ‘স্তন ক্যান্সার সচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। ‘শিশুকে মায়ের দুগ্ধপান স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়’— এটি এ বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য।