করোনাভ্যাক: চীনের করোনা প্রতিরোধী ভ্যাকসিন কতদূর

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা প্রতিরোধী টিকা বানাতে ১০০'র বেশি উদ্যোগ চলছে। এর মধ্যে কয়েকটি টিকার মানবদেহে পরীক্ষা চলছে। তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে আছে এদের অনেকেই।
এই দৌড়ে আছে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন, রাশিয়া তো ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরুও করে দিয়েছে ঢাকঢোল পিটিয়ে। প্রতিবেশী ভারত কাজ করছে তিনটি ভ্যাকসিন নিয়ে, দুটি তাদের নিজেদের তৈরি এবং আরেকটি ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগে তৈরি। ভ্যাকসিনের পেটেন্ট নিয়ে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে এবং এই ভ্যাকসিনটি তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে রয়েছে। এর মাঝে চীনের ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক কাজ করছে তাদের করোনাভ্যাক নিয়ে।
সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন তৈরির কারখানার ভেতরটাতেই একটু উঁকি দেব।
বেইজিং এর একেবারে দক্ষিণে একটি নতুন চকচকে দালান। সাদা দেয়ালের এই দালানের ভেতর ঢুকলেই দেখা যাবে গ্লাভস, মাস্ক আর সুরক্ষা সামগ্রী পরা কর্মীরা পিপেট দিয়ে একটা স্বচ্ছ তরল ছোট ছোট কাঁচের ভায়ালে পুরে দিচ্ছেন।
২,১৫,০০০ বর্গফুট এলাকা জুড়ে এই ভ্যাকসিন উৎপাদন কেন্দ্রটি সম্প্রতি নির্মাণ করেছে চীনা ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা সিনোভাক বায়োটেক।
বিশ্বে করোনা প্রতিরোধী যে ছয়টি ভ্যাকসিন তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে আছে, তাদের তিনটিই চীনের।
সিনোভ্যাকের বিনিয়োগ বিভাগের প্রধান হেলেন ইয়াং বলেন, 'যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলে, তবে এই বছরের শেষ নাগাদ ভ্যাকসিন নিয়ে আশাব্যঞ্জক কোন ফলাফল নিয়ে আসতে পারব আমরা'।
জানুয়ারির শেষের দিকে ভ্যাকসিন তৈরির কাজ শুরু করে এই বায়োটেক সংস্থা। মার্চ মাসে এই ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট নির্মাণের কাজ শুরু হয়। আর চীনের জাতীয় মেডিকেল পণ্য প্রশাসন কর্তৃক অনুমোদিত হলে এই বছরের শেষ নাগাদ ৩০০ মিলিয়ন ডোজ উৎপাদন করা যাবে বলে জানান ইয়াং।
করোনাভ্যাক বানাতে একটু পুরানো পদ্ধতি অবলম্বন করছে সিনোভ্যাক। এখানে একটি অকার্যকর ভাইরাসকে কাজে লাগানো হচ্ছে যা শরীরে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন করে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। একপ্টি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ভাইরাসটিকে বাড়তে দেওয়া হয়। তারপর রাসায়নিক প্রয়োগে মেরে ফেলা হয়, যাতে করে মানব শরীরে প্রবেশের পর তা কোন রোগ সৃষ্টি করতে না পারে।
অনেক আগে থেকেই এই পদ্ধতিটি কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এখনও পোলিও, জলাতংকের মতো বেশ কিছু রোগের ভ্যাকসিন এভাবেই তৈরি করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে ভ্যাকসিনটি উতপাদিত হচ্ছে, সেখানে গবেষকরা পুরো ভাইরাসটি ন্য, বরং এর জীন কাজে লাগাচ্ছেন। এটি তৈরি করতে তুলনামূলক কম সময় লাগে, কেননা এই পদ্ধতিতে পুরো ভাইরাসটি কালচার করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই পদ্ধতির মুশকিল হচ্ছে- কোন জীনটিকে বেছে নেওয়া হবে তা নির্ধারণ করা।
চূড়ান্ত পর্যায়ে বাজারে আনার আগে ভ্যাকসিনের বেশ কয়েকটি ধাপে পরীক্ষা করা হয়। ইয়াং জানান, সিনোভ্যাকের তৈরি ভ্যাকসিনটি একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি প্রাণীর ওপর পাশাপাশি পরীক্ষা চালানো হয়েছে, যাতে করে খুব দ্রুত কার্যকর ফলাফল বের করে আনা যায়।
মে মাসে বিজ্ঞানভিত্তিক সাময়িকী 'সায়েন্স' এ প্রাণিদেহে ভ্যাকসিন প্রয়োগের ফলাফল প্রকাশ করে সিনোভ্যাক। এতে তারা জানায়, প্রথম পর্যায়ে বিভিন্ন প্রজাতির ইঁদুর ও স্তন্যপায়ীর ওপর ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করেছে তারা। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬০০ স্বেচ্ছাসেবকের শরীরে প্রয়োগ করে দেখা গেছে, ভ্যাকসিন প্রয়োগের ১৪ দিনের মাথায় শরীরে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয়েছে।
কিন্তু তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের জন্য আরও অনেক বড় পরিসরে পরীক্ষার প্রয়োজন।
কিন্তু বর্তমানে চীনে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক কম। সেক্ষেত্রে কি করা যায়? ইয়াং জানান, ব্রাজিলের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে সংস্থাটি। প্রায় ৩৬ লাখ করোনা শনাক্ত হয়েছে ব্রাজিলে। গত জুলায় মাসে ব্রাজিলের সাও পাওলো ইন্সটিটিউটের সঙ্গে কাজ শুরু করে সিনোভ্যাক। দেশটির ৯ হাজার স্বাস্থ্য কর্মীর শরীরে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করেছে তারা। দেখা গেছে, সারাক্ষণ করোনা রোগীর চিকিৎসা করেও করোনায় আক্রান্ত হননি তাদের কেউই। বিনিময়ে ব্রাজিলকে ১২০ মিলিয়ন ডজ ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠানটি।
পরীক্ষা-নীরিক্ষা চলতেই থাকবে। ব্রাজিলের বুটানটান ইন্সটিটিউটের প্রধান ডিমাস কোভাস বলেন, ২টি ডোজ নেওয়ার পরই মূলত শরীরে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হবার নমুনা দেখা গেছে। আমি এ ব্যাপারে খুবই আশাবাদী। আগামী জানুয়ারিতেই ব্রাজিলের নাগরিকের জন্য ভ্যাকসিনটি বাজারে আনা সম্ভব হবে বলে ধারণা করছি আমরা।
সূত্র: সিএনএন