জাদুকর মেসি, ফাইনালে আর্জেন্টিনা

শুরুটা দেখে মনে হয়েছিল রাজত্ব করতে যাচ্ছে অসাধারণ ফুটবল খেলে সেমি-ফাইনালে ওঠা ক্রোয়েশিয়া। প্রথম ৩০ মিনিট ম্যাচে খুঁজেই পাওয়া গেল না আর্জেন্টিনাকে। ছন্দময় ফুটবলে দাপট দেখিয়ে খেলতে থাকে ক্রোয়াটরা। কিন্তু এরপর হঠাৎ-ই বদলে গেল দৃশ্যপট। ম্যাচের পরের সময়টুকু জাদু দেখিয়ে গেলেন লিওনেল মেসি নামের জাদুকর। বাঁ পায়ের জাদুকরী সব ছোঁয়ায় ভুবন ভোলানো ফুটবলে নিজে গোল করলেন, করালেন হুলিয়ান আলভারেসকে দিয়ে। দাপুটে জয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে গেল আর্জেন্টিনা।
মঙ্গলবার কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের প্রথম সেমি-ফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে আর্জেন্টিনা। এ নিয়ে ষষ্ঠবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠলো লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের দেশটি। ২০১৪ সালের পর দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে ওঠার স্বাদ নিলেন আর্জেন্টাইন ফুটবলের স্বপ্নবাহক মেসি। বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে অপরাজেয় থাকার রেকর্ড অক্ষুন্ন রাখলো দুইবারের চ্যাম্পিয়নরা। এ নিয়ে বিশ্বকাপে খেলা ৬টি সেমি-ফাইনালের সবগুলোতে জিতলো তারা। দারুণ জয়ে নেওয়া হলো ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ২০১৮ বিশ্বকাপে হারের বদলাটাও।
ম্যাচ খেলতে নেমেই একটি রেকর্ডে নাম বসিয়ে নেন মেসি। বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার মাইলফলকে তিনি ধরে ফেলেন জার্মানির কিংবদন্তি লোথার ম্যাথাউসকে, দুজনই খেলেছেন ২৫টি করে ম্যাচ। ফাইনাল খেলতে নামলেই রেকর্ডটি নিজের করে নেবেন আর্জেন্টাইন ফুটবল জাদুকর। সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ড ছোঁয়া মেসি পরে গোল করে আর্জেন্টিনার হয়ে গড়েন রেকর্ড। বিশ্বকাপে দেশটির সর্বোচ্চ গোলদাতা গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে ছাড়িয়ে গেলেন ফুটবলের এই বিস্ময়। বিশ্বকাপে মেসির গোল এখন ১১টি, বাতিস্তুতার ১০টি।
এবারের বিশ্বকাপে শিরোপা স্বপ্ন পূরণের পথে দুর্বার গতিতে ছুটে চলা মেসি গোল করেছেন ৫টি, যা এখন পর্যন্ত যৌথভাবে আসরের সর্বোচ্চ। ফ্রান্সের তারকা ফরোয়ার্ড কিলিয়ান এমবাপ্পের গোলও ৫টি। কিন্তু মেসির মাহাত্ম্য কেবল গোল দেওয়াতে নয়, গোল করানোতেও। এতে তিনি গড়েছেন অনন্য এক রেকর্ড, যেখানে তার পাশে নেই আর কেউ। একই বিশ্বকাপে তিনটি ভিন্ন ম্যাচে গোল ও অ্যাসিস্ট করা একমাত্র খেলোয়াড় (১৯৬৬ সাল থেকে হিসাব রাখা শুরু হয়) রেকর্ড সাতবারের এই ব্যালন ডি'অর জয়ী। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ভিন্ন পাঁচ আসরে অ্যাসিস্ট করার কীর্তি আগেই গড়েন মেসি।
আর্জেন্টিনার ৩-০ গোলের জয়, ক্রোয়েশিয়া যে উড়ে গেছে; তা বলাই বাহুল্য। অথচ ম্যাচের শুরুর ৩০ মিনিট, বল দখল ও আক্রমণ সাজানোসহ সবখানে দাপট দেখিয়েছেন মদ্রিচ-পেরিসিচরা। ম্যাচের ফল যাই হোক, সাধারণত বল দখলে এগিয়ে থাকে আর্জেন্টিনা। কিন্তু এই ম্যাচে দেখা গেছে উল্টোটা। ৬১ শতাংশ সময় বল নিজেদের পায়ে রাখে ক্রোয়েশিয়া। বারবার আক্রমণ সাজিয়ে গোলমুখে ১২টি শট নেয় তারা, এর মধ্যে ২টি ছিল লক্ষ্যে। কিন্তু একবারও জালের ঠিকানা মেলেনি।
ভিন্ন কৌশলে খেলা আর্জেন্টিনা এদিন বল দখলে রাখতে পেরেছে মাত্র ৩৯ শতাংশ, যা তাদের নামের সাথে বেমানানই। কিন্তু এই সময়টুকুতেই তারা যেভাবে আক্রমণে গিয়ে ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণদূর্গ তছনছ করে দিয়েছে, সেটা অবিশ্বাস্য। বেশিরভাগ সময়ে পাল্টা আক্রমণে যাওয়া আলবিসেলেস্তেরা গোলমুখে শট নেয় ৯টি, এর মধ্যে সাতটি ছিল লক্ষ্যে। পেনাল্টি থেকে গোল করেন মেসি। পরে জোড়া গোল করেন আলভারেস। এর মধ্যে জাদুকরী ছোঁয়ায় একটি গোলের যোগান দেন মেসি।
৩৪তম মিনিটে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। আগের দুই ম্যাচে ক্রোয়াটদের জয়ের নায়ক ডমিনিক লিভাকোভিচ এ সময় ডি-বক্সের মধ্যে ভুল করে বসেন। মাঝমাঠ থেকে বাড়ানো বল ক্রোয়েশিয়ার ডি-বক্সের মুখ থেকে কুড়িয়ে সামনে আগান আলভারেস। দলকে বাঁচাতে ছুটে আসা লিভাকোভিচ ফাউল করে বসেন আলভারেসকে। পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। জোরালো শটে গোল করে আর্জেন্টাইনদের উল্লাসে মাতান মেসি।
ব্যবধান দ্বিগুণ করতে সময় নেয়নি দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। ৩৯তম মিনিটে মেসির পাস থেকে বল পেয়ে মাঝমাঠের আগে থেকে দৌড় শুরু করেন আলভারেস। সব বাধা পেরিয়ে গেলেও বক্সের মুখে বল হারাতে বসেছিলেন, কিন্তু প্রতিপক্ষের পায়ে লেগে ফেরা বল টোকা দিয়ে সামনে বাড়ান তিনি। বোর্না সোসা সুযোগ পেয়েছিলেন ক্রোয়েশিয়াকে বাঁচানোর। কিন্তু এই ডিফেন্ডারের দুর্বল শটে বল লাগে আলভারেসের বুকে, বল নামিয়ে ডান পায়ের শটে গোল আদায় করে নেন তিনি।
৬৯ মিনিটে ৩-০ গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। এ সময় মেসি হয়ে ওঠেন জাদুকর। অনন্য ফুটবল প্রদর্শনীতে ডান দিক দিয়ে আক্রমণে যান সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার। এ সময় মেসির সাথে লেগেই থাকেন ক্রোয়েশিয়ার অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার ইয়োস্কো গাভারদিওল। কিন্তু মেসি জাদুর কাছে তিনি পরাস্থ, কারকুরি দেখিয়ে কোণা থেকে ছোট বক্সে বল পাঠালেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক। যেখানে থাকা আলভারেস প্লেসিংয় শটে সহজেই বল জালে জড়ান।
বিশ্বকাপ সাক্ষাতে ক্রোয়েশিয়ার চেয়ে সাফল্যে এগিয়ে গেল আর্জেন্টিনা। কাতার বিশ্বকাপের এই ম্যাচের আগে দুটি ম্যাচ খেলেছিল তারা, দুই দলই একটি করে ম্যাচ জেতে। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ক্রোয়েশিয়াকে ১-০ গোলে হারায় ক্রোয়েশিয়া। ২০ বছর পর প্রতিশোধ নেয় ক্রোয়াটরা। ২০১৮ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বেই আলবিসেলেস্তেদের ৩-০ গোলে হারায় ক্রোয়েশিয়া। এবার একই ব্যবধানে মধুর প্রতিশোধটা নিয়ে নিলো মেসির দল।