এক যুগ পরে এসেও প্রতিশোধ চায় ঘানা, মাফ চাইবেন না সুয়ারেজ

২০১০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ঘানার বিপক্ষে সুয়ারেজের সেই 'হ্যান্ডবল' মনে আছে?
সেই কীর্তি অনেকের মতে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগের ঘটনা আবার অনেকের চোখে ক্ষমার অযোগ্য বিশ্বাসঘাতকতা। এর কারণেই ঘানার চিরশত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন লুইস সুয়ারেজ, আফ্রিকাবাসীদের কাছে বনে গিয়েছেন ভিলেন।
আজও এল পিস্তোলেরোকে ক্ষমা করতে পারেননি ঘানাবাসীরা; এমনকি এক যুগ পরে এসেও প্রতিশোধের জয় দেখিয়ে দিতে চান দেশটির প্রেসিডেন্টও।
এদিকে ক্ষমা চাইতে নারাজ সুয়ারেজ। তার ভাষায়, দল ও দেশের জন্য সর্বোচ্চটুকু দিতে লাল কার্ড নিতে দ্বিধা করেননি তিনি।
আগামীকাল (২ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ সময় রাত নয়টায় ঘানা মুখোমুখি হবে উরুগুয়ের। ঘানার সামনে এখন সুযোগ উরুগুয়েকে ২০২২ বিশ্বকাপ থেকে বিদায় করে দিয়ে সেই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়া, যে ঘটনায় বিশ্বকাপ জেতার জেতার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গিয়েছিল ব্ল্যাক স্টারসদের।
কী হয়েছিল সেই ম্যাচে?
২০১০ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যচ; মুখোমুখি উরুগুয়ে এবং ঘানা।
বিশ্বকাপের প্রথম আসরসহ মোট দুইবারের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে। কিন্তু তাদের গত ৫০ বছরে লাতিন আমেরিকার এ দেশটির সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল ২০১০ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছান। বহু বছর পর এতদূর আসতে পারায় সেই ম্যাচটিতে জেতা তাদের জন্য ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে, ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব টপকাতে পারেনি ঘানা। ম্যাচটিতে জিতে গেলে তারা বনে যেন সেমিফাইনাল খেলা প্রথম আফ্রিকান দেশ। কাজেই জোহানেসবার্গের এফএনবি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এ ম্যাচে জেতা কোনোপক্ষের জন্যই কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
খেলার প্রথমার্ধে সালি মুনতারি একটি গোল করে ঘানাকে ১-০তে এগিয়ে রাখেন। কিন্তু ৫৫ মিনিটে সমতা ফেরান উরুগুয়ের কীংবদন্তী ফুটবলার দিয়েগো ফোরলান। ৯০ মিনিট শেষেও বজায় থাকে এ সমতা, বহু চেষ্টা করেও কোনো দল প্রতিপক্ষের জালে বল ফেলতে পারেনি। এদিকে ছিটকে পড়লেই ভেঙ্গে যাচ্ছে জুলে রিমে জেতার স্বপ্ন; কেবল একটা গোলের জন্য মরিয়া উভয় দল।
অতিরিক্ত সময় মিলিয়ে ম্যাচটির তখন ১২০ মিনিট চলে। খেলার লোমহর্ষক এই শেষ মুহূর্তে উরুগুয়ের পেনাল্টি এরিয়াতে একটি ফ্রি কিক পেয়ে যায় ঘানা। গোল হলে উরুগুয়ের বিদায় ঘণ্টা নিশ্চিতভাবে বেজে উঠত। কারণ ম্যাচে ফিরে আসার জন্য ন্যূনতম সময় যে আর নেই তাদের হাতে!
গোললাইন বরাবর ছিলেন তরুণ স্ট্রাইকার সুয়ারেজ; পা দিয়ে ঠেকিয়েছিলেন প্রাথমিক আক্রমণ। ঘানার ডমিনিক আদিয়াহের প্রতিঘাতে আবার ফিরে আসে বল। এবারে এক অঘটন ঘটিয়ে বল ঠেকান সুয়ারেজ; এক হাতে বল আটকিয়ে হ্যান্ডবল করেছিলেন এ ফুটবলার।

নিয়মানুযায়ী সুয়ারেজকে দেওয়া হয় লাল কার্ড, পেনাল্টি কিক পেয়ে যায় ঘানা। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে ঘানা উঠে যাবে সেমিফাইনালে; প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে রেকর্ড গড়বে ফুটবলের ইতিহাসে।
গোল করার ভূমিকা বর্তায় অধিনায়ক আসামোয়াহ জিয়ানের ওপর। কিন্তু গোটা আফ্রিকাবাসীকে হতাশ করে স্নায়ুচাপে ক্রসবারে বল মারেন জিয়ান, আর হঠাৎ যেন অক্সিজেন ফিরে পায় উরুগুয়ে। পরে টাইব্রেকারে হেরে ৪-২ ব্যবধানে বিদায় নিতে হয়েছিল ঘানাকে। দলের জয়ে সুয়ারেজের উদযাপন দেখে আরও ব্যথিত হয়ে পড়েন ঘানার ফুটবলাররা।
অথচ সুয়ারেজ হ্যান্ডবল না করলেই নিশ্চিত পরের রাউন্ডে চলে যেত আফ্রিকান দেশটি। পুরো আফ্রিকার কাছে আরও বড় অনুপ্রেরণার উদাহরণ হয়ে থাকতে পারতেন তারা। তাই অনেকের কাছে, বিশেষ করে ঘানাবাসীর কাছে 'ভিলেন' বনে যান সুয়ারেজ।
ফিরে দেখা
২০১০ এর জুলাই ১০ তারিখেল উন্মাদ সে রাতের কথা স্মরণ করে ঘানার মিডফিল্ডার ইব্রাহিম আইয়ু বলেন, 'আমি মনে করেছিলাম আমরা জিতে যাব।'
দ্য অ্যাথেলেটিককে ইব্রাহিম বলেন, 'কেবল ঘানা নয়, আমরা আফ্রিকার জন্য খেলছিলাম। অনুভব করতে পারছিলাম, আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সমগ্র আফ্রিকা।'
ইব্রাহিম সেসময় ছিলেন অতিরিক্ত খেলোয়াড়। ডাগ আউটের অন্যান্য সদস্যের মতো জিয়ানের পেনাল্টি কিকে জয়ের উদযাপন করতে প্রায় প্রস্তুত ছিলেন তিনি। গোল হলেই দৌড় দেবেন মাঠে। প্রথম আফ্রিকান জাতি হিসেবে সেমি ফাইনালে ওঠার আনন্দে মেতে উঠবেন সবাই।
এর আগে অতিরিক্ত চাপের মুখে সার্বিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টি গোল করেছিলেন জিয়ান। কিন্তু এবারের স্নায়বিক চাপ সেগুলোকে ছাড়িয়ে যায়। যাবেই বা না কেন! পুরো আফ্রিকা তার দিকে চেয়ে রয়েছে যে!
"আমরা সবাই জিয়ানের ওপর আস্থা রেখেছিলাম, তিনি নিজেও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। স্টিফেন আপ্পিয়াহ তাকে বল এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, 'যাও, গোল কর। গোটা আফ্রিকাকে গর্বিত বানাও,'" বলেন ইব্রাহিম।
রেফারি বেনকুয়েরেনকার হুইসেলে কয়েক কদম এগিয়ে উরুগুয়ের জালের উদ্দেশ্যে বল মারলেন জিয়ান, আর দেখলেন ক্রসবারে লেগে ফিরে আসছে বল। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি।
বেজে উঠল শেষ ঘণ্টা। মাথায় হাত দিলেন জিয়ান। অবিশ্বাস নিয়ে স্তব্ধ ঘানার রাজধানী আক্রা।

সুয়ারেজের এহেন কাজকে ভুলতে পারেননি আফ্রিকানরা। ইব্রাহিমের মতে, শুধু ঘানা নয়, গোটাআফ্রিকা সুয়ারেজকে ঘৃণা করে।
এক যুগ পরে এসেও এখনো ঘৃণা? এমন প্রশ্নের জবাবে ইব্রাহিম বলেন, 'হ্যাঁ, আমরা ঘৃণা করি তাকে। আমরা প্রতিশোধ চাই।'
কাতার বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগেও 'প্রতিশোধের আলোচনায়' মুখর হয়ে পড়ে ঘানার সামাজিক মাধ্যম। এইচ গ্রুপে পর্তুগাল এবং সাউথ কোরিয়ার মতো দল থাকলেও রোনালদো এবং সন হিয়ুং-মিনের সাথে লড়াইয়ের কথা কেউ ভাবেনি, কথা উঠেছে কেবল সুয়ারেজকে নিয়ে।
শুধু সাধারণ জনগণ নয়, ফুটবল প্রশাসকরাও এর বাইরে নন। ঘানা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট কার্ট ওক্রাকুর কাছে এটি প্রতিশোধের সময়।
বাদ যান না দেশটির স্বয়ং প্রেসিডেন্ট নানা আকুফো আড্ডো। তিনি বলেন, 'প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমরা ১২ বছর ধরে অপেক্ষা করেছি। নিশ্চিত করে বলছি, এবারে সুয়ারেজের হাত তাদের বাঁচাতে পারবে না।'
সাবেক প্রেসিডেন্ট জন মাহামাও একই সুরে তাল মেলালেন। 'কাউকে না হারালেও, উরুগুয়েকে হারাতেই হবে,' বলেন মাহামা।
ইব্রাহিম আইয়ুর ছোট ভাই অন্ড্রে হলেন একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি ২০১০ এর সেই ম্যাচে ছিলেন এবং বর্তমানেও ঘানার জাতীয় দলে আছেন।
তার ভাষ্যমতে, এটি প্রতিশোধ হোক বা না হোক, একই সংকল্প নিয়ে খেলতে নামবেন তারা। কারণ তারা অবশ্যই জায়গা পেতে চান শেষ ষোলোতে।
'আমার কাছে ফুটবলই বড়। প্রতিশোধ নিয়ে কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা সর্বোচ্চ ভালো খেলতে চাইব, আর তাদের হারিয়ে দেওয়ার কৌশল খুঁজতে থাকব,' বলেন অন্ড্রে।
মাফ চাইতে নারাজ সুয়ারেজ
আত্মজীবনী মাই স্টোরি: ক্রসিং দ্য লাইন-এ সুয়ারেজ লেখেন, 'আমার এ চেষ্টা করা আবশ্যক ছিল।'
"বিপর্যস্ত অবস্থায় মাঠ থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলাম। ক্রন্দনরত অবস্থায় মাথায় কেবল ঘুরছিল, 'আমরা বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়লাম, ছিটকে পড়লাম।'"
৩৫ বছর বয়সী এ ফুটবলার বলেন, 'সবাই বলেছে আমি জঘন্য একটা কাজ করেছি বা আমি স্বার্থপরের মতো আচরণ করেছি। কিন্তু আমি হাত দিয়ে গোল রুখেছি কারণ আমার কোনো বিকল্প সিদ্ধান্ত ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, এটি সিদ্ধান্ত নেওয়ারও ব্যাপার নয়, এটি ছিল একটা প্রতিক্রিয়া। প্রতারণা নয়, আমার মনে হচ্ছিল আত্মবিসর্জন দিয়েছি আমি। এটি মোটেই স্বার্থপরতার বিষয় নয়, আমার দেশকে, আমার দলকে সর্বোচ্চটা দিতে চেষ্টা করেছিলাম।'

আজ (১ ডিসেম্বর) প্রেস কনফারেন্সে ঘানার একজন সাংবাদিক আবার সুয়ারেজের সেই 'হ্যান্ড অব গড'-এর কথা তোলেন। ঘানায় সুয়ারেজ 'স্বয়ং শয়তান' হিসেবে পরিচিত বলেও জানান ওই সাংবাদিক।
তবে মতামতে অটল থাকেন সুয়ারেজ। জবাবে তিনি বলেন, 'আমি সেজন্যে মাফ চাইব না। ঘানার খেলোয়াড় (জিয়ান) পেনাল্টি মিস করেছেন আমি নই। কোনো খেলোয়াড়কে আহত করলে তখন হয়তো আমি মাফ চাইতাম।'
'সে পরিস্থিতিতে লাল কার্ড নিয়েছি। যে পেনাল্টি মিস করেছে, আমার জায়গায় থাকলে তিনিও হয়তো একই কাজ করতেন,' যোগ করেন সুয়ারেজ।
এসবিনেশন-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটু কম আবেগীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখলে একপাক্ষিক মনে হবে না। ম্যাচের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে হ্যান্ডবলের মতো নিয়মভঙ্গ করেন সুয়ারেজ, তবে সাথে সাথেই উপযুক্ত শাস্তি পেয়ে যান তিনি। বিশ্বকাপের নকআউটের মতো চরম গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে খেলায় নামতে হয় 'যেকোনো উপায়ে জেতা'র মানসিকতা নিয়ে। ভুলে কিংবা স্নায়বিক চাপে, সুয়ারেজের স্থানে ঘানার কোনো খেলোয়াড় থাকলে হয়তো তিনিও এমন কাজ করে বসতেন।

ফুটবলের উন্মাদনাকে নিয়ন্ত্রণ এরাখতে পারেননি সুয়ারেজ। নিজের দেশের হয়ে সর্বোচ্চটা চেষ্টা করেছিলেন তিনি। গোলের সময় যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কেবল হাত দিয়েই সম্ভব হতো সে গোল আটকানো। ভেবেছিলেন ছয় গজের মধ্যে এতসব খেলোয়াড়দের ভিড়ে রেফারির চোখে ধুলো দেবেন।
নকআউট পর্ব
২০১০ বিশ্বকাপের দীর্ঘ এক যুগ পর আগামীকাল (২ ডিসেম্বর) মুখোমুখি হতে চলেছে দেশ দুটি।
নকআউট পর্বে যেতে হলে এই ম্যাচে জিততে কিংবা ন্যূনতম ড্র করতে হবে ঘানার। এইচ গ্রুপে চতুর্থ স্থানে থাকা উরুগুয়ের থেকে দুই পয়েন্টে এগিয়ে ঘানার অবস্থান দ্বিতীয়। শেষ ষোলোতে পৌঁছাতে হলে জিততেই হয়ে সুয়ারেজদের, এছাড়া কোনো বিকল্প নেই তাদের।