বিশ্বজুড়ে মেয়াদোত্তীর্ণের পথে লাখ লাখ করোনার টিকা
নেদারল্যান্ডসের লেইডেন শহরের একটি সরকারি অফিসের ফ্রিজে কয়েক মাস ধরে পড়ে আছে ৯০টির মতো ছোট সাদা বক্স, যার ভেতর রয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ডোজ। মহামারী নিয়ন্ত্রণের এই মহৌষধগুলো কিছুদিনের মধ্যেই জায়গা করে নেবে ডাস্টবিনে। কেননা এগুলোর গায়ে লেখা আছে ছয় অঙ্কের একটি সংখ্যা- ০৮,২০২১।
পুরো হল্যান্ডজুড়েই এরকম অনেক টিকার ডোজ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার মুখে, অথবা হয়েই গেছে উত্তীর্ণ। দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, স্থানীয় ডাক্তারদের জোর দাবির মুখেও এসব টিকা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগে বাইরের কোন দেশে পাঠানোর চেষ্টা করেনি নেদারল্যান্ডস সরকার।
শুধু হল্যান্ড না, বিশ্বজুড়েই এই ঘটনা ঘটছে। রেকর্ড সময়ে কোটি কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন ও বিতরণের পর এখন সেসব ডোজ মেয়াদোত্তীর্ণের দিকে হাঁটছে। হল্যান্ডের মতো ধনী রাষ্ট্রগুলোয় টিকার চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন ফ্রিজে থেকে থেকেই নষ্ট হচ্ছে হাজারো ডোজ।
লেইডেন শহরেই গত মাসে ৬০০ ডোজ টিকা ফেলে দেয়া হয়েছে। আগস্টের শেষদিকে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৮ হাজারে। অক্টোবরের আগে কোন নীতিগত পরিবর্তন না আসলে লেইডেনের ফ্রিজগুলোতে থেকেই মেয়াদোত্তীর্ণ হবে প্রায় ১০ হাজার ডোজ টিকা।
স্থানীয় ডাক্তাররা বলছেন, হল্যান্ডজুড়ে প্রায় ২ লাখ অ্যাস্ট্রজেনেকার ডোজের একই পরিণতি হতে যাচ্ছে।
বিশ্বের সিংহভাগ দেশে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা লোকগুলোর জন্যও যথেষ্ট টিকার ব্যবস্থা নেই। আফ্রিকাজুড়ে গত মাসের শেষেও এক ডোজ টিকা পেয়েছে এমন লোকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২.২ শতাংশ। আর এদিকে হল্যান্ডের অর্ধেকের বেশি মানুষ এরই মধ্যে দুই ডোজ পেয়ে গেছে। ডাচ সরকার জানিয়েছে আইনি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জন্য তারা এসব অব্যবহৃত টিকার ডোজগুলো রপ্তানি করতে পারেনি।
টিকাদান কার্যক্রমে কিছু অপচয় থাকেই। কিন্তু মহামারীর বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিচারে করোনার যেই পরিমাণ ডোজ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে, সেটা আসলেই অস্বাভাবিক। কী পরিমাণ টিকার মেয়াদ ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে, বা শেষের পথে আছে, সেটাও অস্পষ্ট।
পদ্ধতিগতভাবে কোথায় কত ডোজ টিকা মেয়াদোত্তীর্ণের দিকে যাচ্ছে, সেটার হিসাব রাখার জন্যও কোন অভিভাবক সংস্থা নেই। এসব তথ্য বের হয় শুধু সংবাদ প্রতিবেদন আর সরকারি বিবৃতির মাধ্যমেই।
ইজরায়েলে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় গত জুলাইয়ে ফাইজার-বায়োএনটেকের প্রায় ৮০ হাজার টিকার ডোজ ফেলে দেয়া হয়েছে। পোল্যান্ডে বিভিন্ন উৎপাদনকারীর প্রায় ৭৩ হাজার ডোজ টিকা নষ্ট হয়েছে। আর স্লোভেনিয়া মেয়াদোত্তীর্ণের পথে থাকা প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার ডোজ স্পুটনিক ভি টিকার ডোজ রাশিয়াকে ফেরত পাঠিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে শুধু নর্থ ক্যারোলিনাতেই প্রায় আট লাখ ডোজ টিকা নষ্ট হতে চলেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-র দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ৯ই আগস্ট পর্যন্ত আফ্রিকায় মোট ৪,৬৯,৮৬৮ ডোজ টিকা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। ডব্লিউএইচও-র আফ্রিকা অংশের টিকা উৎপাদন ও বিতরণ বিষয়ক সমন্বয়ক রিচার্ড মিহিগো বলেন, 'এখানে সিংহভাগ টিকাই পাঠানো হয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণের কয়েক দিন আগে।'
এই পরিস্থিতি নিয়ে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব স্বাস্থ্য আইনের অধ্যাপক লরেন্স গোস্টিন বলেন, "আমাদের যে পরিমাণ টিকা আছে, সেটা যথেষ্ট নয়। তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে, তারা যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য নষ্ট হচ্ছে। এই টিকাগুলো জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে না। এটি পুরোপুরি একটি বিপর্যয়।'
টিকার মেয়াদ কেন শেষ হয়ে যায় ?
জর্জটাউন স্কুল অফ মেডিসিনের অধ্যাপক জেসি গুডম্যান জানান, মজুদকৃত অন্যান্য ঔষধের তুলনায় টিকার মেয়াদ তাড়াতাড়ি শেষ হয়। যেমন, ইনফ্লুয়েঞ্জার ঔষধ ট্যামিফ্লু বছরের পর বছর ধরে সংরক্ষণ করা যায় ফ্রিজে, করোনার টিকার ক্ষেত্রে যেটা সম্ভব না।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে করোনার টিকার কার্যকারিতাও কমতে থাকে বলে জানিয়েছেন জনাব গুডম্যান। বিশেষ করে ফাইজার ও মডার্নার তৈরিকৃত এমআরএনএ টিকা বেশি দ্রুত নষ্ট হয়।
সাধারণত, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। আর তা অনুমোদন দেয় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। প্রথমদিকের টিকাগুলোয় তথ্য-উপাত্ত কম থাকায় সতর্কতাস্বরূপ মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ কিছুটা এগিয়ে আনা হয়েছিল।
রাখবেন না ফেলে দিবেন?
অ্যাস্ট্রজেনেকার টিকা সম্বন্ধে নেতিবাচক প্রচারের জন্য গত মাস থেকেই এই টিকার চাহিদা অনেক কমে গিয়েছে নেদারল্যান্ডসে।
গত মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেলে দেয়া টিকার ছবি দেখে ডাচ ডাক্তাররা মিলে একটি অ্যাপ তৈরি করে, যারা মাধ্যমে এসব টিকাকে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই পুনর্বিতরণ করার ব্যবস্থা করে তারা।
কিন্তু দ্রুতই এই টিকার চাহিদা আরও কমে যায়। দেশের ৫৫ শতাংশ মানুষ টিকা নিয়ে নিয়েছেন ইতিমধ্যে। আর অ্যাস্ট্রজেনেকার টিকার জন্য সরকার একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমা ঠিক করে দেয়ায় এই টিকার চাহিদা হল্যান্ডে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি চলে যায়।
তখন ডাক্তাররা মিলে বাইরের কোন দেশে টিকা দরকার, সেটা খুঁজতে থাকেন। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নামিবিয়া আগ্রহও দেখায়। একজন ডাক্তার তখন নিজে গিয়ে এসব টিকা পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাব রাখলেও সরকারি বিধিনিষেধের জন্য তা আর সম্ভব হয়নি।
যদিও এরপর ডাচ সরকার নামিবিয়াকে ৭৫ হাজার অ্যাস্ট্রজেনেকা ডোজসহ অন্যান্য টিকার ডোজ দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
'যথেষ্ট সময় পাইনি আমরা'
টিকাগুলো শেষ পর্যন্ত যাদের দরকার তাদের কাছে পৌঁছুলেও মেয়াদের তারিখটার জন্য প্রায়শই ঝামেলা হয়ে যায়। মিহিগো জানান, আফ্রিকার সিংহভাগ দেশই টিকার প্রতিটি ডোজ বিতরণের জন্য সময় পেয়েছে তিন-চার মাসের মতো। কিন্তু যাতায়াতের বিলম্বের জন্য এই সময়টা আরও কমে এসেছে অনেক জায়গায়।
আফ্রিকান ইউনিয়ন থেকে আসা হাজার হাজার ডোজ টিকা বিতরণের জন্য লাইবেরিয়া সময় পেয়েছিল মাত্র ১৫ দিন। শেষে প্রায় ২৭ হাজার ডোজ টিকা ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছিল তারা। লাইবেরিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী উইলহেমিনা জাল্লাহ বলেন, 'যথেষ্ট সময় পাইনি আমরা'।
বেনিন তিন মাস ধরে বিতরণের চেষ্টা করে গত জুলাইয়ে প্রায় ৫১ হাজার ডোজ টিকা ফেলে দিয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলো রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি তদন্তের জন্য টিকা বিতরণ বন্ধ করে দেয়ার পর ভয়ে অনেকে আর টিকা নিতে চায়নি বেনিনে।
মালাউই সরকার গত মে মাসে প্রায় ২০ হাজার মেয়াদোত্তীর্ণ অ্যাস্ট্রজেনেকার টিকা জনসম্মুখে পুড়িয়ে দেয়, শুধু জনগণকে দেখানোর জন্য যে তারা মেয়াদোত্তীর্ণ টিকা গ্রহণ করবে না।
এছাড়া ফিলিস্তিনের মতো বেশ কিছু রাষ্ট্র দ্রুত মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে এমন টিকার চালান গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
মেয়াদের তারিখ মাঝে মাঝে পরিবর্তনীয়। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জনসন অ্যান্ড জনসন টিকার মেয়াদ বাড়িয়ে সাড়ে চার মাস থেকে ছয় মাস করেছে তারা। রাশিয়ান ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের একজন প্রতিনিধি বলেছেন, তারা আশা করছেন স্পুটনিক ভি -এর মেয়াদ ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে এক বছর করা হবে। এই ধরনের পদক্ষেপ টিকার অপচয় কিছুটা কমাতে পারে।
কিছু বিশেষজ্ঞ আশা করছেন, জাতিসংঘ সমর্থিত বিশ্বব্যাপী টিকা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ 'কোভ্যাক্স', বা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই টিকার ডোজগুলোকে যেখানে প্রয়োজন সেখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা করার জন্য প্রয়োজন ধনী রাষ্ট্রগুলোর স্বদিচ্ছার, যা এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে না কারোর মধ্যে।
সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট
