সংস্কার ব্যয়, অবস্থানগত সমস্যায় আর্থিক সংকটে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল

মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকার ব্যবসায় কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও, হোটেলটির মালিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেডের লোকসান দিন দিন বাড়ছে।
২০২২ সাল শেষে বাংলাদেশ সার্ভিসসেসের পুঞ্জীভূত লোকসান (অ্যাকিউমুলেটেড লস) দাঁড়িয়েছে ৫৩১ কোটি টাকা।
মূলত, ঋণের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে বড় সংকটে পড়েছে ১৯৮৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া এই কোম্পানি।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, হোটেলটি সংস্কারের জন্য অগ্রণী ব্যাংক থেকে ৫৭৩ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ সার্ভিসেস। হোটেল সংস্কারে ব্যয় হয়েছে ৭৩২ কোটি টাকা। সুদ ও নন-কারেন্ট ঋণসহ এখন কোম্পানির মোট দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৫৫ কোটি টাকা।
ঋণের বিপরীতে জমি, ভবনসহ সংস্কার কাজের জিনিসপত্র মর্টগেজ রাখা হয়।
কর্মকর্তারা বলছেন, হোটেলটির সংস্কারের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ সার্ভিসেস। সংস্কারের সময় প্রায় চার বছর ধরে হোটেলটি বন্ধ থাকায় এখান থেকে কোনো রাজস্ব আদায় করতে পারেনি কোম্পানি।
তারা বলছেন, ঋণের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে কোম্পানির আর্থিক সংকট আরও তীব্র হয়েছে।
তবে শুরুতে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলেও এখন পরিশোধ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানির কর্মকর্তারা।
হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে হোটেলটির দুরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। বিমানবন্দর থেকে দূরে হওয়ার কারণে এখানে বিদেশি অতিথিদের আগমন কম হয় বলে জানান বাংলাদেশ সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আতিকুর রহমান।
এতে আয়ের ওপর প্রভাব পড়ছে জানিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "বিমানবন্দর থেকে অবস্থান দূরে হওয়ায় কোম্পানির ওপর প্রভাব পড়ছে। যানজটের কারণে আসতে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় বিদেশি অতিথিও কম আসছে এখানে।"
২০১৪ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) সংস্কারের জন্য হোটেল সেবা বন্ধের আগে বাংলাদেশ সার্ভিসেসের মুনাফা হয়েছিল ৩.২১ কোটি টাকা।
এরপর গত ১০ বছর টানা লোকসানে রয়েছে সরকারি এই কোম্পানিটি। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে লোকসান হয় ১১০.৯৫ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর ২০২২-২৩ এর প্রথম ছয়মাস, অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত লোকসান হয়েছে ৪৬.৪৭ কোটি টাকা।
সংস্কারের পর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে চালু হয় বাংলাদেশ সার্ভিস লিমিটেডের হোটেল সেবা। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলস গ্রুপের ব্যবস্থাপনায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা কার্যক্রম চালু হয়। এর আগে, বাংলাদেশ সার্ভিস রূপসী বাংলা হোটেল নামে হোটেলটি পরিচালনা করেছে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বলাকা এক্সিকিউটিভ লাউঞ্জ, ইন্টারকন্টিনেন্টালের পাশে বিএসএল অফিস কমপ্লেক্স এবং বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারও পরিচালনা করে বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেড।
আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে সংস্কার
আগামী ৩০ বছর হোটেলটি পরিচালনার জন্য ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল গ্রুপ (এশিয়া প্যাসিফিক)- এর সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেড।
ম্যানেজিং কোম্পানির প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মান বাস্তবায়নের জন্য ৭৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে হোটেলের সংস্কার কাজ পরিচালনা করা হয়।
এই ব্যয়ের ৮০ ভাগ ব্যাংক ঋণ এবং বাকি ২০ ভাগ কোম্পানির নিজ উৎস থেকে খরচ করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলস গ্রুপ একটি ব্যবস্থাপনা চুক্তির অধীনে নিজস্ব স্টাইলে হোটেলটি ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করে আসছে।
গ্রুপটি যুক্তরাজ্যে অবস্থিত একটি বিখ্যাত আন্তর্জাতিক হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, যার ব্যবস্থাপনায় রয়েছে ৬,০৬১ টি হোটেল।
এছাড়া, হোটেল ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় এই গ্রুপের ১০০ বছরেরও বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
বেড়েছে হোটেলের অকিউপেন্সি
সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে হোটেলটির অকিউপেন্সি আগের বছরের তুলনায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২.২০ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই হার ছিল ১৬.৩৭ শতাংশ।
কোম্পানির তথ্যানুযায়ী, হোটেল থেকে আয়ের ৮০ শতাংশ আসে বিদেশি অতিথিদের কাছ থেকে; আর স্থানীয় অতিথি থেকে আসে বাকি ২০ শতাংশ।
এরমধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে কোম্পানির মোট রাজস্ব ১১০.২১ কোটি টাকার মধ্যে ৬৮ শতাংশ এসেছে ফুড অ্যান্ড বেভারেজ খাত থেকে। আর রুম ভাড়া থেকে এসেছে বাকি ২৪ শতাংশ।
বিআইসিসি'র লিজ চুক্তির মেয়াদ শেষ
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য লিজ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের ৩০ জুন।
২০১২ সালে গণপূর্ত বিভাগ থেকে দশ বছরের জন্য লিজ পেয়েছিল কোম্পানিটি।
এখন মিউচ্যুয়াল অ্যাগ্রিমেন্ট অনুযায়ী, নতুন অপারেটর নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেড বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা চালিয়ে যাচ্ছে।