বিনিয়োগ পেতে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করল পদ্মা ব্যাংক

'বিপর্যয়' থেকে রক্ষার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ব যেকোন ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের অনুরোধ জানানোর দুই মাসের মাথায় বড় অংকের বিদেশি বিনিয়োগ পেতে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ডেল মর্গান এন্ড কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড।
এই চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানিটি আগামী ৪-৬ মাসের মধ্যে আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে পদ্মা ব্যাংকের জন্য ৭০ কোটি ডলার বা ৫৯০০ কোটি টাকা বিদেশি বিনিয়োগ সংগ্রহ করবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে ব্যাংকটি। এর মধ্যে ২৪০০ কোটি টাকা ইক্যুইটি ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে এবং বাকিটা ঋণ হিসেবে পাওয়া যাবে।
২০১৩ সালে ফারমার্স ব্যাংক নামে যাত্রা শুরুর পরপরই ভয়াবহ অনিয়ম দুর্নীতিতে ডুবতে বসা ব্যাংকটিকে বাঁচাতে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ৭১৫ কোটি টাকা মূলধন যোগান দেয় রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠান পদ্মা ব্যাংকের ৬৫% শেয়ারের অংশীদার।
পরে নাম পাল্টে পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড হিসেবে নবযাত্রা শুরু করলেও ব্যাংকটি টিকে থাকার মতো আর্থিক ভিত্তি পায়নি। বিপুল পরিমাণ মূলধন সংকট, আয়যোগ্য সম্পদের প্রায় চারগুণ দায়যোগ্য সম্পদ, শেয়ারহোল্ডার ইক্যুইটি নেগেটিভ হওয়ার আশঙ্কা ও গত ছয় মাসে ১২০ কোটি টাকা লোকসান করার তথ্য তুলে ধরে গত ৮ জুলাই যেকোন রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের সঙ্গে মার্জার বা এক্যুইজেশনের অনুরোধ জানিয়ে গত ৮ জুলাই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠি দেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসান খসরু।
বৃহস্পতিবার ডেল মর্গান এন্ড কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষরের পর কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ পাওয়া গেলে দেশের সরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে মার্জার করার প্রয়োজনীয়তা থাকবে কি-না, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এমন প্রশ্নে সরাসরি কোন উত্তর দেননি এহসান খসরু।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনি জানান, 'বোর্ডের একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত রয়েছে যে স্থানীয়ভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবসা এবং মূলধন বৃদ্ধিতে সমন্বয় আনতে ব্যাংক এমএন্ডএ (মার্জার এন্ড একুইজিশন) লেনদেন করবে। ব্যাংক প্রস্তাবিত এমএন্ডএ পদক্ষেপের একাধিক বিকল্প বিশ্লেষণ করছে।'
বিদেশ থেকে বিনিয়োগ ও ঋণ পাওয়ার পদ্মা ব্যাংকের এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ব্যাংকটির শেয়ারহোল্ডার সোনালী ব্যাংক ও আইসিবির শীর্ষ নির্বাহীরা। তবে ডেল মর্গান ও কোম্পানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত এমওইউ'তে কি রয়েছে, তা এখনও জানেন না তারা।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পদ্মা ব্যাংকের পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান টিবিএসকে বলেন, পদ্মা ব্যাংক মূলধন সংকটে ভুগছে। বিদেশ থেকে ইক্যুইটি ইনভেস্টমেন্ট পাওয়া গেলে তা ব্যাংকের জন্য ভালো হবে। তাছাড়া, বিদেশ থেকে কম সুদে ঋণ পাওয়া গেলে ব্যাংকটির পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানোও সহজ হবে।
আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পদ্মা ব্যাংকের পরিচালক মো. আবুল হোসেন টিবিএসকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিনিয়োগ পাওয়ার উদ্যোগের কথা ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে আলোচনা হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পাওয়া সাপেক্ষে এ ধরণের বিনিয়োগ আনআ যেতে পারে।
'ডেল মর্গান এন্ড কোম্পানির সঙ্গে সাক্ষরিত এমওইউতে কি রয়েছে, তা আমরা এখনও জানি না। বোর্ড এমওইউ পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে'- জানান তিনি।
পদ্মা ব্যাংক জানায়, ব্যাংকের পক্ষে এমডি ইহসান খসরু ও ডেল মর্গানের পক্ষে প্রেসিডেন্ট ও সিইও নিল মরগানবেসার এমওইউতে স্বাক্ষর করেন। ওই সময় পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ শারাফাত, ডেল মর্গানের চেয়ারম্যান রব ডেলগাডো ও এমডি সামির আসাফ উপস্থিত ছিলেন।
এমওইউ অনুযায়ী বিনিয়োগ পেলে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী হবে জানিয়ে এহসান খসরু টিবিএসকে বলেন, ভবিষ্যতে ব্যবসার বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে ব্যাংকের নতুন মূলধন প্রয়োজন। ব্যাংকের সঠিক ব্যবসা এবং বিনিয়োগের কৌশল বাস্তবায়িত হওয়ায় নতুন মূলধনের সঙ্গে আর্থিক অবস্থার অবশ্যই উন্নতি হবে। এছাড়াও বিদেশি বা স্থানীয় এমএন্ডএ (মার্জার এন্ড একুইজিশন) অবশ্যই ব্যাংকের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়াবে।
এহসান বলেন, প্রথমত ডেলমর্গান একটি ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি যা পদ্মা ব্যাংকে প্রচুর পরিমাণে (প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার ইকুইটি ক্যাপিটাল এবং ৩৫০ মিলিয়ন ডেবট ডলার মূলধন) বিনিয়োগের সুবিধার্থে নিযুক্ত হয়েছে।
'পদ্মা ব্যাংকে বিনিয়োগের আগ্রহ একাধিক কারণে হয়েছে। যেমন- ব্যাংকের ৫৮ টি শাখা রয়েছে। নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল), অপারেটিং লস এবং অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিওর মতো আর্থিক সূচকগুলি নতুন ব্যবস্থাপনা পরিষদ ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পর বছরের পর বছর ধরে উন্নতির ধারা দেখছে। এটি একটি ভালো দিক। আরও শক্তিশালী ব্যালেন্স শীট সহ আগামী ৩ বছরে ব্যাংকের শক্তিশালী আইপিও সম্ভাবনা থাকবে'- তিনি যোগ করেন।
এহসান বলেন, অন্যান্য কিছু বিষয় যেমন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক এবং বোর্ডে আইসিবি'র উপস্থিতি, মার্কেটপ্লেসে ব্যবস্থাপনার শক্তির প্রতি আস্থা দেখিয়ে নতুন জনবল নিয়োগ করা প্রতিফলিত করে যে ব্যাংক একটি পজিটিভ বিকাশের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
'এছাড়াও ইক্যুইটি এবং লোনে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের গতিশীলতা এবং বৃদ্ধির কৌশলের উপর ভিত্তি করে, অতীতের ঘটনা বা বিদ্যমান এনপিএলের উপর নয়। তারা জানে যে বোর্ড এবং ব্যবস্থাপনায় আগের লোকজন আর নেই, তাদের জায়গায় নতুন লোক এবং নতুন বোর্ড এসেছে।'
এই এমওইউ স্বাক্ষরকে বাংলাদেশের আর্থিকখাতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় হিসেবে উল্লেখ করে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সারাফাত বলেন, মার্জার এন্ড এক্যুইজেশন লেনদেনের আওতায় পদ্মা ব্যাংক আন্তর্জাতিক আর্থিক ক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করেছে।
পদ্মা ব্যাংক বিদেশি বিনিয়োগের যে সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তা এগিয়ে নিতে পারবো বলে আশা করেছেন ডেল মার্গন এন্ড কোম্পানির চেয়ারম্যান রব ডেলগাডো।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ডেল মর্গানের এমডি সামির আসাফও উপস্থিত ছিলেন, যিনি এর আগে রহিমআফরোজ (বাংলাদেশ) লিমিটেড এর গ্রুপ সিইও এবং আইপিডিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট ফাইন্যান্স হিসেবে সাত বছরেরও বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছেন।
পদ্মা ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কোভিড সময়েও খেলাপি ঋণ আদায়ে পদ্মা ব্যাংকের সাফল্য অনেক। গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ব্যাংকখাতে সার্বিক খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়লেও এই সময়ে পদ্মা ব্যাংক উল্টো ৫৮ কোটি টাকা আদায় করেছে।
গত জুন শেষে ব্যাংকটির মোট ঋণ ৬৭০৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৫১৯ কোটি টাকা। এটি বিতরণ করা মোট ঋণের ৬১.৫৫%।
এই ঋণের প্রায় পুরোটাই নাম বদলের আগের সময়কার উল্লেখ করে পদ্মা ব্যাংক বলেছে, নতুন নামে পুনর্গঠনের পর থেকেই অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। গত মার্চে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৩.২৭%, গত মাসে তা ১.৭২% কমেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আনে ব্যাংকটিকে রক্ষা করতে পারলে তা ভালো হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের দায়-দেনা কে কতোটুকু নেবে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর একমত হতে হবে।
এই বিনিয়োগ ও ঋণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কি হবে সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যালোচনা করে অনুমোদন দেবে বলে আশা করছি। যাতে প্রত্যাবাসনের সময় দেশের বৈদেশিক মুদ্রা মজুদে বড় ধরণের চাপ সৃষ্টি না করে।