চেরনোবিলের রহস্যময় ‘কালো ছত্রাক’, যা হয়তো তেজস্ক্রিয়তা খেতে পারে
১৯৯৭ সালের মে মাস। নেলি ঝদানোভা পা রাখলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত এক জায়গায়—ইউক্রেনের চেরনোবিলের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ধ্বংসাবশেষে। ১৯৮৬ সালের সেই ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর জায়গাটি পরিত্যক্ত। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি যা দেখলেন, তাতে তার চোখ কপালে উঠল। তিনি একা নন! সিলিং, দেয়াল, এমনকি ইলেকট্রিক তারের ভেতরেও বাসা বেঁধেছে এক ধরনের কালো রঙের ছত্রাক বা 'ফাঙ্গাস'।
ভাবা হয়েছিল, এই জায়গায় কোনো প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়। বাইরের জঙ্গল আর মাঠে মানুষ না থাকায় হয়তো নেকড়ে বা বুনো শূকর ফিরে এসেছে। কিন্তু ধ্বংসপ্রাপ্ত রিঅ্যাক্টরের একদম ভেতরের ঘরগুলোতে, যেখানে তেজস্ক্রিয়তা বা রেডিয়েশনের মাত্রা কল্পনাকেও হার মানায়, সেখানে এই কালো ছত্রাক দিব্যি বেঁচে আছে।
শুধু বেঁচে নেই, তারা যেন তেজস্ক্রিয়তাকে ভালোবাসছে! ঝদানোভা দেখলেন, এই ছত্রাকগুলো কোনোভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। বরং আগের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, এগুলো তেজস্ক্রিয় কণার দিকেই বেড়ে উঠছে। এবার দেখা গেল, তারা সরাসরি সেই বিষাক্ত রিঅ্যাক্টরের হৃদপিণ্ডে পৌঁছে গেছে।
এই আবিষ্কার বিজ্ঞানের জগতকে নাড়িয়ে দিল। তেজস্ক্রিয়তা যেখানে প্রাণ ধ্বংস করে, সেখানে এই ছত্রাক উল্টো সেটাকে 'খেয়ে' বেঁচে থাকছে। ঝদানোভার এই কাজ মহাকাশ গবেষণায় নতুন আশা জাগাচ্ছে। হয়তো এই ছত্রাক ব্যবহার করেই একদিন মহাকাশচারীদের কসমিক রেডিয়েশন থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
চেরনোবিলের সেই কালো অধ্যায়
ঝদানোভার যাওয়ার ঠিক ১১ বছর আগে, ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল, চেরনোবিলের ৪ নম্বর রিঅ্যাক্টরে এক রুটিন পরীক্ষার সময় ঘটেছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক দুর্ঘটনা। মুহূর্তের ভুলে বিশাল বিস্ফোরণে ছড়িয়ে পড়েছিল তেজস্ক্রিয় কণা বা 'রেডিওনিউক্লাইড'। তেজস্ক্রিয় আয়োডিনের কারণে প্রথম কয়েক দিনেই অনেকে মারা যান, পরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন আরও অনেকে।
মানুষকে বাঁচাতে ৩০ কিলোমিটার এলাকা বা 'জোন অফ অ্যালিয়েনেশন' সিল করে দেওয়া হয়। কিন্তু মানুষ সরে গেলেও জায়গাটি দখল করে নেয় ঝদানোভার সেই কালো ছত্রাক।
সূর্যের আলোর বদলে রেডিয়েশন!
গাছ যেমন সূর্যের আলোর দিকে ডালপালা মেলে, এই ছত্রাকগুলোও ঠিক তেমনি তেজস্ক্রিয়তার দিকে ছুটে চলেছে। ঝদানোভা একে নাম দিয়েছেন 'রেডিওট্রপিজম'। কিন্তু এটি ছিল এক ধাঁধা। কারণ তেজস্ক্রিয়তা বা আয়নাইজিং রেডিয়েশন সূর্যের আলোর চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। এটি বুলেটের মতো ডিএনএ ছিঁড়ে ফেলে, কোষ ধ্বংস করে দেয়।
তাহলে এই ছত্রাকগুলো বাঁচছে কী করে? রহস্য লুকিয়ে আছে 'মেলানিন' নামের এক রঞ্জক পদার্থে। মানুষের ত্বকের রঙ কালো বা ফর্সা হয় এই মেলানিনের কারণেই। চেরনোবিলের ছত্রাকগুলোও কালো ছিল কারণ এদের কোষে ছিল প্রচুর মেলানিন। ঝদানোভার ধারণা, আমাদের ত্বকের মেলানিন যেমন সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে বাঁচায়, তেমনি ছত্রাকের মেলানিন তেজস্ক্রিয়তা থেকে তাদের রক্ষা করছে। শুধু রক্ষা নয়, এটি তেজস্ক্রিয়তাকে শক্তিতে রূপান্তর করছে!
২০০৭ সালে নিউইয়র্কের অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানী একাতেরিনা দাদাচোভা এই গবেষণাকে আরও এগিয়ে নেন। তিনি দেখেন, চেরনোবিলের মতো তেজস্ক্রিয় পরিবেশে এই কালো ছত্রাকগুলো সাধারণ অবস্থার চেয়ে ১০ শতাংশ দ্রুত বাড়ে। তার ধারণা, গাছ যেমন সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে সূর্যের আলো থেকে খাবার তৈরি করে, এই ছত্রাকগুলো তেমনি 'রেডিওসিন্থেসিস' প্রক্রিয়ায় তেজস্ক্রিয়তা থেকে শক্তি সংগ্রহ করছে।
দাদাচোভা বলেন, "তেজস্ক্রিয়তার শক্তি সাধারণ আলোর চেয়ে ১০ লাখ গুণ বেশি। মেলানিন হয়তো সেই শক্তিকে এমনভাবে রূপান্তর করে যা ছত্রাক খাবার হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।"
২০২২ সালে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে চেরনোবিলের সেই একই প্রজাতির ছত্রাক 'ক্ল্যাডোস্পোরিয়াম স্ফেরোস্পার্মাম' পাঠানো হয়। সেখানে মহাকাশের শক্তিশালী কসমিক রেডিয়েশনের মধ্যেও এটি দিব্যি বেড়ে ওঠে। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নিলস অ্যাভেরেশ বলেন, "আমরা দেখেছি, পৃথিবীতে সাধারণ অবস্থায় এটি যতটা বাড়ে, মহাকাশে রেডিয়েশনের মধ্যে এটি ১.২১ গুণ দ্রুত বেড়েছে।"
শুধু তাই নয়, মহাকাশ স্টেশনে এই ছত্রাকের একটি পাতলা স্তর রেডিয়েশন আটকাতে বা 'শিল্ড' হিসেবে দারুণ কাজ করেছে।
মঙ্গল অভিযানে নতুন আশা
চীন ও আমেরিকা আগামী কয়েক দশকের মধ্যে চাঁদে ঘাঁটি বানানোর পরিকল্পনা করছে। স্পেসএক্স ২০২৬ সালের মধ্যে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু মহাকাশের এই দীর্ঘ যাত্রায় সবচেয়ে বড় শত্রু হলো কসমিক রেডিয়েশন। পৃথিবী আমাদের বায়ুমণ্ডল দিয়ে রক্ষা করে, কিন্তু মহাকাশে সেই সুরক্ষা নেই।
লোহা বা প্লাস্টিকের তৈরি ভারী সুরক্ষা কবচ মঙ্গলে নিয়ে যাওয়া অনেক খরচসাপেক্ষ। নাসার বিজ্ঞানী লিন রথচাইল্ড কচ্ছপের উদাহরণ দিয়ে বলেন, "কচ্ছপ যেমন নিজের ঘর পিঠে নিয়ে ঘোরে, আমাদেরও মহাকাশে ঘর নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু লোহা বা কাঁচ বয়ে নেওয়া অনেক কঠিন।"
এখানেই কাজে আসতে পারে এই ছত্রাক। বিজ্ঞানীরা ভাবছেন, চাঁদ বা মঙ্গলে গিয়ে এই ছত্রাক দিয়েই ঘরবাড়ি বা দেয়াল তৈরি করা সম্ভব। একে বলা হচ্ছে 'মাইকো-আর্কিটেকচার'। এটি নিজে থেকেই বেড়ে উঠবে এবং রেডিয়েশন থেকে মহাকাশচারীদের রক্ষা করবে।
চেরনোবিলের সেই পরিত্যক্ত জনপদে যে ছত্রাক আজ রাজত্ব করছে, কে জানে, হয়তো তা একদিন সৌরজগত জয়ে মানুষের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে উঠবে!
