ইউক্রেনের বিষয়ে অবস্থান বদল যুক্তরাষ্ট্রের, ৫০ হাজার কোটি ডলারের চুক্তিও চায়

প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায়– গত এক সপ্তাহ কূটনৈতিকভাবে এক দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে গেছে ইউক্রেন।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে ট্রাম্প রাশিয়ার সাথে সরাসরি সংলাপ শুরুর ঘোষণা দেন। তাঁর পূর্বসূরী জো বাইডেন ইউক্রেন বিষয়ে অঙ্গীকার করেছিলেন যে 'ইউক্রেনকে ছাড়া ইউক্রেনের বিষয়ে কোনো আলোচনা নয়'; কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির সরাসরি খেলাপ করেই মস্কোর সাথে সমঝোতার উদ্যোগ নেন ট্রাম্প।
একইদিন 'বাস্তববাদী' হওয়ার পরামর্শ দিয়ে রাশিয়ান পররাষ্ট্রনীতিরই প্রতিধ্বনি শোনা গেছে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথের কণ্ঠে। ব্রাসেলসে ইউক্রেন ডিফেন্স কন্ট্যাক্ট গ্রুপের বৈঠকে যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, ইউক্রেনকে তার ২০১৪ সালের আগের সীমান্তে ফেরানোর লক্ষ্যটি বাস্তবসম্মত নয়। সংলাপের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করাও অবাস্তব হবে বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে।
এক পর্যায়ে ন্যাটোর সদস্য পদ দেওয়া হবে ২০০৮ সাল থেকে ইউক্রেনকে এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। একইসঙ্গে ১৯৯১ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের যে সীমানাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল– সেটি পুনরুদ্ধার করাকেও সমর্থন দিয়ে গেছে।
এই অবস্থায়, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের ইউক্রেন নীতির রদবদল নিয়ে চিন্তিত ইউরোপের মিত্ররা। জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়াকে দেওয়া ছাড়গুলো একতরফা, যা গুরুতর ভুল।
তবে ইউক্রেনের জন্য পরিস্থিতি আরও শোচনীয় দিকে গড়ানো তখনও বাকি ছিল।
মঙ্গলবার সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে রুশ কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনার জন্য আসেন ট্রাম্পের কর্মকর্তারা। ওইদিনই ট্রাম্প যুদ্ধ শুরুর দায় ইউক্রেনকে দেন, এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো সাহায্য দেশটির ক্ষমতাসীনরা চুরি করেছে বলে ইঙ্গিত দেন।
ট্রাম্প তার ব্যক্তিগত অবকাশযাপন কেন্দ্র মার- এ -লাগোতে সাংবাদিকদের বলেন, আজকে আমি শুনেছি, তারা (ইউক্রেন) বলছে, (রিয়াদের আলোচনায় অংশ নিতে) আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। কিন্তু, আপনাদের তিন বছর আগেই এ যুদ্ধের ইতি টানা উচিৎ ছিল। যুদ্ধ শুরু করাটাই আপনাদের উচিৎ হয়নি।
যদিও ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন চালালে শুরু হয় এ যুদ্ধ।
ট্রাম্প দাবি করেন, নিজ দেশে জেলেনস্কির প্রতি জনগণের সমর্থনের হার মাত্র ৪ শতাংশ। এছাড়া ইউক্রেনকে যে ৩৫ হাজার কোটি ডলারের সহায়তা দিয়েছে— জেলেনস্কিকে কখনো তার হিসাবও দেননি।
তবে কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের চলতি মাসে করা এক জাতীয় জরিপের ফল বলছে, ৫৭ শতাংশ ইউক্রেনীয় এখনও জেলেনস্কিকে সমর্থন করেন।
জার্মানির কিয়েল ইনস্টিটিউট অব ওয়ার্ল্ড ইকোনমি ইউক্রেনকে দেওয়া পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক, আর্থিক ও মানবিন সহায়তার হিসাব রাখছে। সংস্থাটির তথ্যমতে, গত তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্র ১১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার অনুদান দিয়েছে ইউক্রেনকে, একইসময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দিয়েছে ১৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বেশি সহায়তা।
তাই ট্রাম্পের এ ধরনের অভিযোগের পর স্বভাবতই ক্ষোভ দেখা দেয় কিয়েভে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি যার ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। পরেরদিনই তিনি কিয়েভে সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাম্প অপতথ্যের জালে জড়িয়ে পড়েছেন।
এই মন্তব্যের আরও কড়া জবাব দেন ট্রাম্প। সামাজিক মাধ্যম 'এক্স' (সাবেক টুইটারে) তিনি লেখেন, সফল একজন কৌতুকাভিনেতা নির্বাচন ছাড়া একজন স্বৈরাচারীতে পরিণত হয়েছেন। যার কর্মকাণ্ড খুবই খারাপ।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের এই অবস্থানে, বিস্মিত ও দারুণ উদ্বিগ্ন হয়েছে ইউরোপের দেশগুলোও।
এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে একটি শান্তি আলোচনা শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। কিন্তু ওই আলোচনা শুরুর আগে ইউক্রেনকে একটি খনিজ চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছেন ট্রাম্প।
প্রস্তাবে ট্রাম্প যুদ্ধের সময় ওয়াশিংটন কিয়েভকে যে সামরিক সহায়তা দিয়েছে, তার বিনিময়ে এখন ইউক্রেনের কাছ থেকে ৫০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের খনিজ সম্পদের মালিকানা চেয়েছেন।
তবে ট্রাম্পের প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছেন জেলেনস্কি। গত বুধবার তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত যে সামরিক সহায়তা পাঠিয়েছে, তা ট্রাম্প যে পরিমাণ অর্থ ফেরত চাইছেন, তার থেকে অনেক কম। এ ছাড়া ট্রাম্পের প্রস্তাবে সুনির্দিষ্ট করে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি।
জেলেনস্কি প্রস্তাব বাতিল করার পর ট্রাম্প তাঁকে 'স্বৈরশাসক' আখ্যা দিয়ে বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি নিশ্চিত করতে জেলেনস্কিকে দ্রুত সরে যেতে হবে অথবা তিনি তাঁর দেশ হারাতে পারেন।