যে গোপন আলোচনার মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত হলো গাজা জিম্মি চুক্তি

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের আকস্মিক হামলার পর গোষ্ঠীটি বহু মানুষকে জিম্মি করে। এর খুব অল্প সময় পর তাদের মুক্তির জন্য কয়েক সদস্যের একটি দল গঠনের অনুরোধ নিয়ে হোয়াইট হাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাতার সরকার।
কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় এবং ইসরায়েল, হামাস ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতিতে বন্দি বিনিময়ের ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরুর দিকে নেওয়া এ উদ্যোগ অবশেষে আলোর মুখ দেখল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কাতারের আমির ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে জরুরি সংলাপ চালিয়ে আসছিলেন। তার এই কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার গোপনীয় প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত চুক্তিতে এসে দাঁড়াল।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র পরিচালক বিল বার্নস, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান ও তার ডেপুটি জন ফিনার এবং মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন দূত ব্রেট ম্যাকগার্কসহ আরও অনেকের পরিশ্রমও এতে জড়িত।
বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুইজন কর্মকর্তা চুক্তি পর্যন্ত পৌঁছাতে শীর্ষ নেতাদের এই প্রচেষ্টাগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। এ চুক্তি অনুযায়ী, চার দিনের যুদ্ধবিরতির এই সময়ে ইসরায়েলের কারাগারে আটক ১৫০ জন ফিলিস্তিনির মুক্তির বিনিময়ে গাজায় জিম্মি ৫০ জনকে মুক্তি দেওয়া হবে।
কর্মকর্তারা জানান, হামাসের হামলার পর কাতার জিম্মিদের বিষয়ে সংবেদনশীল তথ্য ও তাদের মুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে হোয়াইট হাউসের কাছে গিয়েছিল। কাতারিরা ইসরায়েলিদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি নিয়ে কাজ করার জন্য একটি ছোট দল (কাতারের ভাষায় 'সেল') প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিল।
কর্মকর্তারা আরো জানান, জ্যাক সুলিভান মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন দূত ব্রেট ম্যাকগার্ক এবং জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের আরেক কর্মকর্তা জোশ গেলৎজারকে এ রকম একটি দল গঠনের নির্দেশ দেন। অন্যান্য প্রাসঙ্গিক মার্কিন সংস্থাগুলোকে না জানিয়েই এটি করা হয়েছিল। কারণ কাতার এবং ইসরায়েল এ বিষয়ে অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষার দাবি করেছিল।
প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে মার্কিন দূত ম্যাকগার্ক কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুলরহমান বিন জসিম আল থানিকে প্রতিদিন সকালে ফোন করতেন। এর পর তাদের মধ্যে হওয়া আলাপের বিস্তারিত প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও জ্যাক সুলিভানের কাছে তুলে ধরতেন।
ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর গাজায় বন্দি ও নিখোঁজ মার্কিন নাগরিকদের পরিবারের সঙ্গে গত ১৩ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আবেগপূর্ণ একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এর কয়েকদিন পর ১৮ অক্টোবর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাথে সংলাপের জন্য বাইডেন তেল আবিব সফর করেন। ওই কর্মকর্তা বলেছেন, নেতানিয়াহু ও তার মন্ত্রিসভার সাথে মানবিক সহায়তার পাশাপাশি আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করা।
এর পাঁচদিন পর ২৩ অক্টোবর হামাসের হাতে জিম্মি দুই মার্কিন নাগরিক নাতালিয়ে ও জুডিথ রানানকে মুক্তি দেওয়া হয়। হোয়াইট হাউসের দলটির প্রচেষ্টা তাদের মুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল।
কর্মকর্তারা বলেন, দুই মার্কিন নাগরিককে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করে যে জিম্মিদের স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব। এটি বাইডেনকেও আশ্বস্ত করেছিল যে গঠিত ছোট দলটির মাধ্যমে কাতার এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারবে।
এখন অন্য জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে একটি জোরালো প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার শুরু থেকে সিআইএ পরিচালক বার্নস মোসাদের পরিচালক ডেভিড বার্নিয়ার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে আসছেন।
কর্মকর্তারা বলেন, বাইডেন বিপুল সংখ্যক জিম্মির মুক্তির বিষয়ে একটি সুযোগ লক্ষ্য করেছিলেন। আর বন্দিদের জন্য একটি চুক্তিই ছিল যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করার একমাত্র বাস্তবসম্মত উপায়।
ইসরায়েল গত ২৪ অক্টোবর গাজায় স্থল আক্রমণের প্রস্তুতির সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে হামাস নারী ও শিশুদের মুক্তির জন্য একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। যার অর্থ একটি বিরতি ও স্থল আক্রমণ বিলম্বিত হওয়া।
গাজায় স্থল আক্রমণ বিলম্বিত করা উচিত কি না তা নিয়ে ইসরায়েলিদের সাথে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন মার্কিন কর্মকর্তারা।
জিম্মিদের বেঁচে থাকার বিষয়ে ইসরায়েলিদের কাছে কোনো প্রমাণ ছিল না। ইসরায়েলিরা তাই যুক্তি দেখিয়েছিল যে, ওসব শর্ত তাদের অভিযান বিলম্বিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। হামাস দাবি করেছিল, যুদ্ধবিরতি শুরু না হওয়া পর্যন্ত তারা কাকে বন্দি করেছে তা নির্দিষ্ট করতে পারবে না।
মার্কিন ও ইসরায়েলিরা হামাসের অবস্থানকে অযৌক্তিক হিসেবে বিবেচনা করেছিল।
বাইডেন পরবর্তী তিন সপ্তাহে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। কারণ সম্ভাব্য জিম্মি মুক্তির প্রস্তাবগুলো বারবার এদিক-ওদিক হচ্ছিল। এর মধ্যে দাবি উঠেছিল যে হামাস জিম্মিদের তালিকা, পরিচয় ও মুক্তির বিষয়ে নিশ্চয়তা দেবে।
কর্মকর্তারা বলেন, প্রক্রিয়াটি বেশ দীর্ঘ এবং জটিল ছিল। দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ কঠিন ছিল। দোহা কিংবা কায়রো থেকে বার্তা গাজায় পাঠাতে হতো।
জিম্মিদের মুক্তির বিষয়টি যখন পর্যায়ক্রমে কার্যকর হওয়ার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে তার আগে বাইডেন কাতারের প্রধানমন্ত্রীর সাথে ফোনে কথা বলেন। তারা কি বিষয়ে কথা বলেছিলেন তা প্রকাশ করা হয়নি।
চুক্তিটির অধীনে প্রথম ধাপে নারী ও শিশু বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে। একইসাথে ইসরায়েলিদের কাছ থেকে ফিলিস্তিনি বন্দিদের সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মুক্তি দেওয়া হবে।
এই ধাপেই জিম্মি সমস্ত নারী ও শিশুর মুক্তির জন্য হামাসের প্রতি জোর দিয়েছিল ইসরায়েল। মার্কিনপক্ষ এতে সম্মত হয় এবং কাতারের মাধ্যমে হামাসের হাতে বন্দি নারী ও শিশুদের বেঁচে থাকার প্রমাণ বা তাদের পরিচয় প্রদানের দাবি করে।
হামাস জানায়, তারা প্রথম ধাপে ৫০ জনের মুক্তির বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারে। তবে জিম্মিদের পরিচয়ের তালিকা তৈরির শর্তে অস্বীকৃতি জানায়।
চুক্তির বিষয়টি সামনে এগিয়ে নিতে গত ৯ নভেম্বর বার্নস দোহায় কাতারি, ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদের নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু চুক্তির অগ্রসরের ক্ষেত্রে মূল যে বাধাটি ছিল তা হলো হামাস জিম্মিদের নাম-পরিচয় না জানানো।
তিন দিন পর বাইডেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে ফোন করেন এবং বয়স, লিঙ্গ ও জাতীয়তাসহ ৫০ জন জিম্মির নাম-পরিচয় শনাক্তকরণ বিষয়ক তথ্যের দাবি করেন।
দুই পক্ষের এই অনড় অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কাতারের আমির বলেছিলেন, সামনে অগ্রসর হওয়ার কোনো ভিত্তি তারা দেখতে পাচ্ছেন না।
বাইডেনের এই ফোনের খুব অল্প সময় পর হামাস ৫০ জন জিম্মির বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে। এটি জানায় প্রথম ধাপে এই ৫০ জনকে মুক্তি দেওয়া হবে।
১৪ নভেম্বরের ফোন করে নেতানিয়াহুকে চুক্তিতে সম্মত হওয়ার বিষয়ে অনুরোধ করেন। এতে নেতানিয়াহু সম্মত হন।
এক কর্মকর্তা জানান, ওই দিনই নেতানিয়াহু একটি বৈঠক থেকে বেরিয়ে ম্যাকগার্কের হাত ধরে বলেছিলেন 'আমাদের এই চুক্তিটি দরকার' এবং তিনি বাইডেনকে কাতারের আমিরের কাছে চূড়ান্ত শর্তে ফোন করার আহ্বান জানান।
কিন্তু এরই মধ্যে গাজায় কার্যকর যোগাযোগ না হওয়ায় আলোচনা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। পরে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে অনুষ্ঠিত এশিয়া-প্যাসিফিক সম্মেলনের এক ফাঁকে বাইডেন কাতারের আমীরকে ফোন করেন এবং জানান এটাই শেষ সুযোগ। কাতারের আমীর তখন চুক্তিটি কার্যকরের চাপ দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়।
১৮ নভেম্বর ম্যাকগার্ক দোহায় কাতারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অন্যদিকে মোসাদের সঙ্গে আলাপে অংশ নেয় বার্নস। বৈঠকে এ চুক্তি কার্যকর করায় সর্বশেষ যে ঘাটতি ছিল সেটি চিহ্নিত করা হয়।
চুক্তিটি আপাতত নারী ও শিশুদের মুক্তির জন্য করা হলেও আশা করা হচ্ছে এ উদ্যোগ অন্য জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে ভূমিকা রাখবে।
পরদিন সকালে কায়রোতে ম্যাকগার্ক মিসরের গোয়েন্দা প্রধান আব্বাস কামিলের সাথে সাক্ষাত করেন। এ বৈঠকে জানানো হয় যে হামাস নেতারা আগের দিন দোহায় প্রায় সবগুলো সমস্ত চুক্তি মেনে নিয়েছে।
সব মিলিয়ে অবশেষে চুক্তিটি চূড়ান্ত হলো।