সেনারা ক্লান্ত, ভরসা করা যাচ্ছে না গোলাবারুদের ওপর: ইউক্রেনের যত প্রতিবন্ধকতা
রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ ১৭তম মাসে গড়িয়েছে। যুদ্ধ এখন একটা নিজস্ব ছন্দে এগোচ্ছে — দুই দেশই একে অপরকে কেবল আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ করছে; কোনো পক্ষই বেশি কিছু অর্জন করতে পারছে না। রাশিয়ান আর্টিলারি এখন আর আগের মতো সফলভাবে আক্রমণ চালাতে পারছে না, আবার রাশিয়ার শক্ত প্রতিরক্ষা ঠেলেও খুব বেশি এগোতে পারছে না ইউক্রেন বাহিনী।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস যুদ্ধক্ষেত্রে এক ডজনের বেশি সময় সফর করে এবং জুন–জুলাই মাসে ইউক্রেনীয় সেনা ও কমান্ডারদের সাক্ষাৎকার নিয়ে যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতির একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
ইউক্রেন তার পাল্টা আক্রমণে যতটুকু সাফল্য পাচ্ছে, তার বিনিময়ে দেশটিকে বিপুল ক্ষতি সামলাতে হচ্ছে। ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী নতুন ও পুরোনো বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এখনো বেগ পাচ্ছে, যেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে এটির অগ্রগতিকে ধীর করে দিচ্ছে।
প্রতিরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে ইউক্রেন এ যুদ্ধে বেশ ভালোভাবে উতরে গেছে। স্টারলিংক-এর স্যাটেলাইট ইন্টারনেট, পাবলিক সফটওয়্যার এবং ড্রোনের কল্যাণে বিভিন্ন কমান্ড সেন্টার থেকে খুব সহজেই রাশিয়ান বাহিনীর গতিবিধির ওপর নজর রাখতে পারছে ইউক্রেন।
কিন্তু আক্রমণাত্মক যুদ্ধের ক্ষেত্রে ইউক্রেনের অর্জন মোটেই আশাজাগানিয়া নয়। পাল্টা আক্রমণের জন্য তথাকথিত জিরো লাইনে রাশিয়ান বাহিনীর সবচেয়ে কাছে অবস্থিত নিজেদের সেনাদল আর একেবারে ফ্রন্টলাইনে যুদ্ধরত সৈন্যদের মধ্যে সমন্বয়সাধনে বেশি সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেনি কিয়েভ।
ইউক্রেনের পদাতিক বাহিনী রাশিয়ান বাহিনীর পরিখায় আক্রমণের হার ক্রমশ বাড়াচ্ছে। তবে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রচুর সৈন্য হারিয়েছে ইউক্রেন, ফলে এসব আক্রমণের জন্য এখন স্বল্প-প্রশিক্ষিত সেনাদের কাজে লাগাতে হচ্ছে দেশটিকে। আবার কোনো একটি স্থান থেকে রাশিয়ান বাহিনীকে হটানোর পর দেখা যায়, ওই স্থান লক্ষ্য করে রুশরা আর্টিলারি হামলা চালানো শুরু করেছে।
এদিকে গোলাবারুদের সংকটেও ভুগছে দেশটি। আবার বিভিন্ন দেশ থেকে গোলাবারুদ পাঠানোয় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন ধাঁচের গোলার লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত হানার ক্ষমতা ভিন্ন ভিন্ন — ফলে বর্তমানে ইউক্রেন বাহিনীকে আগের চেয়ে বেশি গোলা নিক্ষেপ করতে হচ্ছে। আবার বিদেশিমিত্রদের পাঠানো পুরোনো মডেলের অনেক গোলা ইউক্রেনের যুদ্ধ সরঞ্জামকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে, এমনকি আহত হচ্ছেন সৈন্যরাও।
আন্তঃবাহিনী যোগাযোগ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশগুলো যুদ্ধক্ষেত্রের ওপর নজর রাখার জন্য যেসব জটিল মনিটিরিং ব্যবস্থা ব্যবহার করে, তার তুলনায় ইউক্রেন বর্তমানে কম জটিল ও সাদাসিধা নজরদারি সরঞ্জাম ব্যবহার করছে। ইউক্রেনের এসব যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে স্মার্টফোনের মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন, ইন্টারনেটে ব্যক্তিগত চ্যাটরুম, ও চীনের তৈরি ছোটখাটো ড্রোন।
এগুলো যথেষ্ট কার্যকরী হলেও এর একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো পুরো নেটওয়ার্কটিই স্টারলিংক-এর স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো ইউনিটের কাছে ওয়াইফাই সুবিধা না থাকলে এটি দূরে থাকা আর্টিলারি ইউনিটকে গোলন্দাজ হামলার জন্য অনুরোধ করতে পারবে না।
ইউক্রেনের দক্ষিণে এ বছর একদল সৈনিক স্টারলিংক স্যাটেলাইট ব্যবহার করে একটি সাঁজোয়া বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। কিন্তু আক্রমণের সময় নিজেদের গুলিতেই অ্যান্টেনা বিধ্বস্ত হয়। এরকম ছোটখাটো সমস্যা যেমন তৈরি হয়, আবার তেমনি এ ব্যবস্থা কোনোপ্রকার বাধা ছাড়াই মসৃণভাবে কাজ করে যুদ্ধক্ষেত্রে।
পরিখাযুদ্ধ
ইউক্রেনের ৫৯ ব্রিগেডের একটি স্কোয়াডের সেনাদের সারা শরীর ঘামে ভর্তি। গত কয়েক ঘণ্টা ধরে তারা রুশ পরিখায় আক্রমণ চালানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন — ঘাসের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া, কালাশনিকভ থেকে মিথ্যা গুলি চালানো, বিশ্রাম, আবার প্রথম থেকে শুরু করা।
বারবার এ প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো মূল যুদ্ধক্ষেত্রে প্রকৃত আক্রমণের সময় হলে এই দলের মধ্যে যেন কোনো ভয় কাজ না করে। 'আমরা এখনো সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশ নিইনি বটে, তবে তার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি,' বলেন ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী যোদ্ধাদের ওই দলের সবচেয়ে কমবয়সী সেনাদের একজন মিকোলা।
দুই বছরে গড়ানো এ যুদ্ধে এখন দুই পক্ষই প্রতিরক্ষা তৈরি ও সেগুলোর দখল ধরে রাখার বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠেছে। নিজেদের হারানো ভূখণ্ড পুনর্দখলে নিতে ইউক্রেনের সেনাদেরকে নিয়মিতই রাশিয়ান বাহিনীর পরিখায় হামলা চালাতে হচ্ছে। পরিখাযুদ্ধের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে স্নাইপারের মতো বিশেষায়িত প্রশিক্ষণগুলোয় আপাতত অল্প নজর দিচ্ছে ইউক্রেন।
বাখমুতের আশপাশে ইউক্রেন বাহিনী পরিখাযুদ্ধে বেশ ভালো সফলতা পেয়েছে। কারণ এখানে রাশিয়ান বাহিনী অভেদ্য পরিখা তৈরি করার সময় পায়নি। কিন্তু রণাঙ্গনের অন্য অনেক স্থানে সফল পরিখা-আক্রমণ পরিচালনায় সক্ষম এমন সেনা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হচ্ছে ইউক্রেনকে। কারণ দীর্ঘ যুদ্ধে নিজেদের অনেক দক্ষ সেনা ও অফিসারকে হারিয়েছে ইউক্রেন।
'৪০ বছর বয়সী কেউ ভালো পদাতিক সেনা বা মেশিনগান চালক হবেন — তা আপনি কীভাবে প্রত্যাশা করেন?' প্রশ্ন তোলেন যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার একটি ইউক্রেনীয় প্লাটুনের একজন কমান্ডার। তিনি জানান, তরুণ সেনারা যেমন শারীরিকভাবে অন্যদের চেয়ে বেশি সক্ষম, তেমনি তারা অফিসারদের দেওয়া আদেশ নিয়েও বেশি প্রশ্ন তোলেন না।
গোলাবর্ষণ
সিভেরস্ক শহরের বাইরে মার্কিনীদের দেওয়া একটি ১০৫ মিলিমিটার হাউটজার নিয়ে ওত পেতে আছে একটি ইউক্রেনীয় গোলন্দাজ দল। কিছুক্ষণ আগে তাদের 'প্রতিবেশী' আরেকটি হাউটজার কয়েক রাউন্ড গোলা নিক্ষেপ করেছে। একটু পরে স্টারলিংক ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের স্মার্টফোনেও মিশনের আদেশ এল — রাশিয়ার একটি মর্টার দলকে লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করতে হবে।
ক্যামোফ্লজ জালটা তুলে নিয়ে পরপর দুটি গোলা নিক্ষেপ করল দলটি। এরপর আবার ক্যামোফ্লজের জালের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল দলটি।
তাদের মিশন সফল — রাশিয়ান মর্টার টিমকে ধ্বংস করা গেছে। কিন্তু ইউক্রেনের সব গোলন্দাজ দলের জন্য ব্যাপারটি এতটা সহজ নয়।
পাকিস্তান, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, ইরান — আরও অনেক দেশ ইউক্রেনকে গোলা পাঠিয়েছে। বিভিন্ন দেশের গোলার ধরন ভিন্ন ভিন্ন এবং গোলার বয়স আলাদ হওয়ায় এসব গোলা নিক্ষেপ করার আগে বারবার লক্ষ্য ঠিক করে নিতে হচ্ছে ইউক্রেনের গোলন্দাজ দলকে।
একবার গোলা নিক্ষেপ করার পরপরই প্রতিপক্ষও পাল্টা গোলা নিক্ষেপ করে। ইউক্রেনীয় ১০৫ মিলিমিটার হাউটজার দলটি গোলা নিক্ষেপ করার ২০ মিনিট পরই রাশিয়ানরাও গুচ্ছ বোমা, গোলা, রকেট ইত্যাদি নিক্ষেপ করে পাল্টা হামলা চালিয়েছে।
