নিয়মনীতির কোনটাই মানেনি বিএম ডিপো, হতবাক তদন্ত কমিটি!

আইসিডিতে বিপজ্জনক পণ্য রাখতে হলে মানতে হয় দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালা। থাকতে হবে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব নিয়মনীতির কোনটা না মেনেই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল বিএম কনটেইনার ডিপোতে।
বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় চট্টগ্রাম কাস্টমস গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার শফিউদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'বেসরকারি ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোগুলো (আইসিডি) কাস্টমস বন্ডেড এরিয়া। নীতিমালা অনুসরণের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লাইসেন্স নিয়েই আইসিডিগুলো পরিচালনা করতে হয়। তদন্ত কমিটি বিএম ডিপোর ক্ষেত্রে এই নীতিমালাগুলো বাস্তবায়িত হয়েছিলো কিনা তা খতিয়ে দেখছে।'
এ কমিটির এক সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে জানিয়েছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার কোনোটাই না মেনেই পরিচালিত হচ্ছিলো বিএম ডিপো। আইসিডি পরিচালনা করতে হলে আইএসপিএস (ইন্টারন্যাশনাল শিপ এন্ড পোর্ট ফ্যাসিলিটি সিকিউরিটি কোড), আইএমডিজি (দ্য ইন্টারন্যাশনাল ম্যারিটাইম ডেঞ্জারাস কোড) মেনে এবং ফায়ার সার্ভিস নির্দেশিত সেইফটি সিকিউরিটি প্ল্যান্ট স্থাপন করতে হয়। কিন্তু এসব কিছুই ছিলো না ওই ডিপোতে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ৩৩টি কন্টেইনারে ৮৫০ মেট্রিক টন হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিল। কন্টেইনারগুলো ডিপোর ইয়ার্ডে রাখা ছিলো।
অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মফিদুল আলম বলেন, 'বিএম কনটেইনার ডিপো গার্মেন্টস সামগ্রী ও পোলট্রি ফিড রাখার কথা বলে ছাড়পত্র নিয়েছিল। রাসায়নিক রাখার কথা আবেদনে তারা উল্লেখ করেনি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তারা ডিপোতে রাসায়নিকও রেখেছিল। ডিপোতে কী কী রাসায়নিক রাখা ছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।'
চট্টগ্রাম বন্দরের তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানান, 'নিয়মানুযায়ী বিপজ্জনক পণ্য পৃথক কন্টেইনারে রাখতে হয়। কন্টেইনারের গায়ে পণ্যের বিবরণ লিখে দিতে হয়। বিপজ্জনক পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করে দিতে হয়। এছাড়া নির্ধারিত দূরত্বে সংরক্ষিত স্থানে এসব পণ্য সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু ঘটনা তদন্তে ডিপোর কন্টেইনারগুলোতে এসব কিছুই ছিলোনা।'
এদিকে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক পদার্থ রাখার তথ্য জানা ছিল না বিস্ফোরক পরিদপ্তরের। সংস্থাটি জানিয়েছে, ক্যামিকেল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ছিল না বিএম কন্টেইনার কর্তৃপক্ষের।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ও বিস্ফোরক পরিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বিএম কনটেইনার ডিপোতে দাহ্য পদার্থ রাখা হয় বিষয়টি আমাদের জানানো হয়নি। এ ধরণের পণ্য সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ধরণের অবকাঠামো প্রয়োজন। কিন্তু ডিপোতে সেই ব্যবস্থা ছিল না। রিপোর্টে সেসব উল্লেখ করা হবে।'

বেসরকারি আইসিডি/সিএফএস বা অফডক স্থাপন ও পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিমালা অনুযায়ী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর নির্দেশিত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা সুবিধা নিশ্চিত করতে হয়। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, বিপজ্জনক এবং বিস্ফোরক জাতীয় পণ্য, কন্টেইনার সংরক্ষণ ও হ্যান্ডেলিংয়ের ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস (আইএমডিজি) নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষন) মোহাম্মদ মনির হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কেমিক্যাল সংরক্ষণ এবং পরিচালনায় যে ধরনের নিয়মনীতি অনুসরণ করতে হয় সেগুলো ডিপোর কর্মীদের শেখানো হয়নি। যারা এসব বিষয় মনিটরিং করবে তারাও এ বিষয়ে সক্রিয় ছিল না। এমনকি আগুন লাগার পর মালিকপক্ষ ডিপোতে রাসায়নিক থাকার কথাটি চেপে গেছে।'
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন সিকদার বলেন, বিএম ডিপো কারখানায় অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার কিছুই ছিল না। ভেতরে একটি ফুয়েল স্টেশনও রয়েছে। খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা। ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু এসবের কিছুই ছিল না সেখানে। তদন্ত রিপোর্টে এসব থাকবে।'
গত শনিবার রাতে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। আগুন থেকে দফায় দফায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীসহ ৪৪ জন মারা গেছেন। আহত হন দুই শতাধিক। প্রায় ৬১ ঘণ্টা পর গত মঙ্গলবার দুপুরে ডিপোর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে সেনাবাহিনী ঘোষণা দেয়।