৫০ কোটি ডলারে কেনা বিমান এক বছর পরই ৪০ হাজার ডলারে বেচে দিয়েছে আমেরিকা

আধা বিলিয়ন ডলার দিয়ে কেনা বিমান বছরখানেক উড়েছে। ৮৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করে বানানো বিশাল হোটেল এখন পড়ে আছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। হোটেলটা কখনও খোলেইনি। আফগান সেনাবাহিনীর ক্যামোফ্লাজ ইউনিফর্ম বানাতে গচ্চা গেছে ২৮ মিলিয়ন ডলার।
খোদ আমেরিকার ইন্সপেক্টর জেনারেল অভিযোগ তুলেছেন, আফগানিস্তান পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে আমেরিকা অর্থ অপচয় এবং জালিয়াতি করেছে।
পেন্টাগনের হিসাব অনুসারে, আফগানিস্তান যুদ্ধে আমেরিকার মোট খরচ ৮২৫ বিলিয়ন ডলার। তবে সবাই-ই একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে যে পেন্টাগন একেবারেই কমিয়ে বলেছে। এমনকি জো বাইডেনের আনুমানিক হিসাবেও আফগানিস্তান যুদ্ধে আমেরিকার খরচ আসে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। এছাড়াও এ যুদ্ধের জন্য দেশটি যে পরিমাণ অর্থ ঋণ করেছে, তার সুদই ইতিমধ্যে বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
আফগানিস্তানে এমন অনেক প্রকল্পে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পানিতে ঢেলেছে আমেরিকা। সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি অর্থ অপচয়, দুর্নীতি ও জালিয়াতি হয়েছে যেসব প্রকল্পে, সেগুলোর কথা উঠে এসেছে সিএনএনের এক প্রতিবেদনে। চলুন একনজরে দেখে নেওয়া যাক প্রকল্পগুলোতে কত টাকা গচ্চা গেছে আমেরিকার।
১. কাবুলের শীতের কম্বল
কাবুলে বিদ্যুৎ সরবরাহের বিকল্প উৎস হিসেবে ২০০৭ সালে তারাকহিল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হয়। আজারবাইজান থেকে বিদ্যুৎ আসা কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এ ভয়ে কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়।
বিশাল, আধুনিক এই স্থাপনা চলত ডিজেলচালিত টারবাইনে। আফগানিস্তানে তখন ডিজেল-সংকট ছিল। সে সময় দেশটিকে ট্রাকে করে জ্বালানি আনতে হতো। এর ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালানো রীতিমতো সাদা হাতি পোষার মতোই ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণেই খরচ হয়ে যায় ৩৩৫ মিলিয়ন ডলার। বছরে এতে জ্বালানি লাগত প্রায় ২৪৫ মিলিয়ন ডলারের। সাম্প্রতিক এক হিসাবে জানা গেছে, জ্বালানির ওভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতার মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ ব্যবহার করতে পারত আফগান সরকার।

২. আধা-বিলিয়ন ডলারের কার্গো বহর, উড়েছে মাত্র এক বছর
আফগানিস্তানের দুর্বল বিমানবাহিনীতে কার্গো বিমানের প্রয়োজন ছিল। ২০০৮ সালে পেন্টাগন ইটালিয়ান ডিজাইনের জি২২ কেনে, রুক্ষ রানওয়েতে ওঠানামা করার জন্য। প্রথম বছরে বিমানগুলো ভালোই কাজ করেছিল।
কিন্তু উড়োজাহাজগুলো টেকসই ছিল না। এক বছরের মাথায়ই ওগুলো অকেজো হয়ে পড়ে।
ছয় বছর পর ১৬টি অকেজো কার্গো বিমানগু বাতিল মাল হিসেবে ৪০ হাজার ২৫৭ ডলারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই প্রকল্পের পেছনে খরচ হয়েছিল ৫৪৯ মিলিয়ন ডলার।
৩. মরুভূমিতে মেরিন সদর দপ্তর, কেউ ব্যবহারও করেনি, কেউ চায়ওনি
২০১০ সালে আফগানিস্তানের সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকা হেলমান্দে মেরিন সদস্যার সংখ্যা বাড়ছিল। ক্যাম্প লেদারনেকের মূল ঘাঁটিতে একটি কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যদিও কয়েকজন মেরিন জেনারেল বলেছিলেন যে, এর কোনো দরকার নেই।
ওই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ মেরিন জেনারেলরা ফেরত দিতে চাইলেও তা ফেরত নেওয়া হয়নি। তাদের আপত্তি সত্ত্বেও শেষতক ওই মেরিন সদর দপ্তর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু স্থাপনাটি মেরিন কখনও ব্যবহার করেনি। এই প্রকল্পের পেছনে গচ্চা গেছে ৩৬ মিলিয়ন ডলার।
৪. ভুল ক্যামোফ্লাজ নকশার পেছনে ২৮ মিলিয়ন ডলার গচ্চা
২০০৭ সালে আফগান আর্মির জন্য নতুন ইউনিফর্ম তৈরির অর্ডার দেওয়া হয়। আফগান প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়ারদাক বলেছিলেন, তিনি দুর্লভ ধরনের ক্যামোফ্লাজ নকশা চান।
১৩ লাখ সেট ইউনিফর্মের অর্ডার দেওয়া হয়। প্রতি সেট ইউনিফর্মের পেছনে খরচ হয় ৪৩ থেকে ৮০ ডলার। যদিও আমেরিকার দাবি করেছিল যে প্রতি সেট ইউনিফর্মের খরচ ২৫ থেকে ৩০ ডলার।
কিন্তু বিপুল টাকা খরচ করে বানানো ওই ইউনিফর্ম কখনও ব্যবহারই করা হয়নি। এমনকি ব্যবহারোপযোগী কি না, তা-ও পরীক্ষা করে দেখা হয়নি।
পেটেন্ট করা নকশার ইউনিফর্ম কিনতে বাড়তি ২৮ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল।
৫. আফিম উৎপাদনের বিরুদ্ধে লড়তে দৈনিক ১.৬ মিলিয়ন ডলার খরচ
মাদকবিরোধী কর্মসূচিতে আমেরিকা দৈনিক (২০০২ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত) দেড় মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দেশটিতে ৩৭ শতাংশ বেশি আফিম উৎপাদিত হয়েছিল।
২০১৭ সালে আফগানিস্তানে ২০০২ সালের তুলনায় চারগুণ আফিম উৎপাদন হয়েছিল।
৬. অসমাপ্ত রাস্তার পেছনে গচ্চা ২৪৯ মিলিয়ন ডলার
একাধিক দাতা ও বিনিয়োগকারীর অর্থায়নে বিশাল দৈর্ঘ্যের একটি চক্রাকার রাস্তা তৈরি হচ্ছিল আফগানিস্তানে। যুদ্ধের সময় এই রাস্তা নির্মাণে কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। এই প্রকল্পের শেষ দিকে, আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে এই চক্রাকার রাস্তার ২৩৩ কিলোমিটারের একটি অংশ নির্মাণের জন্য ঠিকাদারদের ২৫০ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়।
কিন্তু ওই রাস্তার মাত্র ১৫ শতাংশ নির্মাণ হয়েছে।
২০১৪ সালের মার্চ থেকে ২০১৭ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাস্তার ওই অংশে কোনো কাজই হয়নি। আর যতটুকু হয়েছে, তা-ও নষ্ট হয়ে গেছে।
৭. ৮৫ মিলিয়ন ডলারে তৈরি হোটেল, কিন্তু কখনও খোলেনি
কাবুলে মার্কিন দূতাবাসের পাশে একটি বিশাল হোটেল ও অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের জন্য মার্কিন সরকার ঋণ নিয়ে ৮৫ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল।
কিন্তু ভবনগুলো নির্মাণের কাজ শেষ হয়নি। এমনকি কোনো ভবনই বসবাসের উপযোগী নয়। অথচ এই স্থাপনার জন্য মার্কিন দূতাবাসকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
পরে জানা যায়, যে ঠিকাদার ওই প্রকল্পের কাজ নিয়েছিল, তারা অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এছাড়াও মার্কিন সরকারের যে বিভাগ এই প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছিল, তারা কখনও জায়গাটা দেখতে যায়নি। এমনকি পরবর্তীতে যে কোম্পানিকে প্রকল্পের কাজ তদারকের জন্য ভাড়া করা হয়, তারাও কখনও সাইট পরিদর্শনে যায়নি।
৮. সমুদ্রে তৈরি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র
২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউএসএইড আফগানিস্তানে ৫১০টি যেসব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র তৈরির জন্য তহবিল তুলেছিল। কিন্তু ওই প্রকল্পের প্রায় ৩৫ শতাংশই যে অবস্থানে বলা হয়েছিল, সেই অবস্থানে নেই। তেরোটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র আফগানিস্তানের বাইরে, একটার অবস্থান ভূমধ্যসাগরে। ত্রিশটি কেন্দ্র ইউএসএইড যে প্রদেশে বলেছিল, ওগুলোর বাইরে অবস্থিত।
এছাড়াও ১৮৯টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের কোনো ভৌত অস্তিত্ব নেই।