এসএমই ঋণে নতুন শঙ্কা ট্যাক্স রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র

প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে এখনই দেশের কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়া দুষ্কর।
অথচ আগামী অর্থবছরের বাজেটে পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণ পেতে ট্যাক্স রিটার্ন প্রমাণ জমা দেওয়ার শর্তারোপ সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের ঋণপ্রাপ্তি আরও জটিল করবে।
এমন শঙ্কা জানিয়ে অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া এক চিঠিতে এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) বলছে, এর ফলে প্রান্তিক উদ্যোক্তা ব্যাংকে নিরুৎসাহিত হয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণদাতা মহাজন, কো-অপারেটিভ সোসাইটিসহ ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থার দারস্থ হবে।
করনেট সম্প্রসারণ ও কর সংগ্রহ বৃদ্ধির জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণগ্রহীতা ও ক্রেডিট কার্ডগ্রাহকদের ট্যাক্স রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
অর্থাৎ কোনো গ্রাহক এই পরিমাণ ঋণ নিতে চাইলে ট্যাক্স রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে, যেখানে আগে শুধুমাত্র ই-টিন ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েই একজন উদ্যোক্তা নিতে পারতেন।
শুধু সিএমএসএমই উদ্যোক্তাই নয়, নতুন এই সিদ্ধান্তে ব্যক্তি ঋণ ও ক্রেডিট কার্ডের অর্থায়নও প্রভাবিত হবে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার থেকে সরকারের পাওয়া রাজস্বও প্রভাবিত হবে জানিয়ে কয়েকবছর সময় নিয়ে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার কথা বলছে এবিবি।
তবে এই বছর থেকে নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চাইলে সিএমএসএমই ঋণের সীমা ৫০ লাখ টাকা, ব্যক্তিগত ঋণ সীমা ১০ লাখ ও ক্রেডিট কার্ড ঋণ ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করার সুপারিশ করেছে এবিবি।
অর্থাৎ ট্যাক্স রিটার্ন প্রমাণপত্র জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা শুধুমাত্র এই সীমার বেশি ঋণ নিলেই প্রযোজ্য হবে।
জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান বাড়াতেও সরকারী এসব প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন, এসএমই ফাউন্ডেশন নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছে। ঋণ প্রাপ্তি সহজ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকও বিভিন্ন নীতি সহায়তা প্রদান করছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের বড় সমস্যা অর্থের অভাব। কারণ সহজে তারা ঋণ পায় না। ব্যাংক ঋণ পেতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে পারে না, যার কারণে বড় একটি অংশ ঋণ সুবিধার আওতার বাইরেই রয়ে গেছে।
ব্যাংকিং চ্যানেলে সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের ঋণপ্রাপ্তি সহজ করতেও কাজ করছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান।
তবে সরকারের এই নতুন সিদ্ধান্ত এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন আরও কঠিন করে তুলবে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে এসএমই উদ্যোক্তাদের অর্থের সংস্থান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছে এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, "ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে এখনই এই বাধ্যবাধকতা আরোপ করা ঠিক হয়নি, ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের নির্দেশনা থাকতে পারতো। সিএমএসএমই এখনই ঋণ পেতে নানা জটিলতার সম্মুখীন হয়, নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হলে, তাদের ঋণ পাওয়া আরও জটিল হয়ে পড়বে।"
নতুন সিদ্ধান্তে যত সমস্যা
এবিবি বলছে, ঋণ প্রক্রিয়ায় অনেক নথিপত্রের প্রয়োজন হয়, যাতে সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের অসন্তুষ্টি হচ্ছে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ।
নতুন করে ট্যাক্স রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেওয়ার বাধ্যবাধকতা পুরো ঋণ প্রক্রিয়াকে আরও জটিল ও বিলম্বিত করবে।
উদ্যোক্তাদের ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেওয়ার রশিদ পেতেও অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। সম্পদ ঘোষণার জটিলতা, ট্যাক্স রিটার্ন জমাদানে দীর্ঘসূত্রিতা ও যাচাইকরণে গ্রাহকদের আর্থিক সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না জানিয়ে এবিবি বলছে সিএমএসএমই খাতের অর্থায়নের পথ আরও সংকীর্ণ হবে।
সিএমএসএমই ঋণগ্রহীতার বড় অংশই প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তা। ফলে ট্যাক্স রিটার্ন পূরণ করা অত্যন্ত দূরূহ কাজ। এবিবি বলছে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বছরজুড়ে ট্যাক্স রিটার্ন জমার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন থাকলেও ঋণ আবেদন করতে পারবে না।
কারণ অর্থবছর শেষ হওয়ার সময় পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠান রিটার্ন জমা দেওয়ার সুযোগ পায়। অর্থাৎ নতুন বাধ্যবাধকতায় কাঙ্খিত অর্থায়ন পাবেন না।
পাশাপাশি ব্যাংকের নিজস্ব ব্যবস্থা না থাকায় ট্যাক্স রিটার্ন সনদের সত্যতা যাচাই করাও সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে এবিবি।
ব্যক্তি ও ক্রেডিট কার্ড ঋণে সমস্যা
যারা নতুন চাকরিতে প্রবেশ করে, তাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে মাসিক আয় ন্যূনতম ৩০ হাজার টাকা হলে ঋণ ও ২০ হাজার টাকা আয় করলে ক্রেডিট কার্ড প্রদান করে ব্যাংকগুলো।
মূলত, ই-টিনধারী ব্যক্তিদেরই এই সুবিধা দেয় ব্যাংক। এবিবি মনে করছে, নতুন সিদ্ধান্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে 'ক্যাশলেস সোসাইটি'র জন্য বাধাসম হবে এবং ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার সীমিত হবে।
নতুন প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ট্যাক্স রিটার্নের শর্তারোপে গ্রাহকরা তাৎক্ষণিক ঋণ ও ক্রেডিট কার্ড নিতে অসমর্থ হবে। ফলে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী ডিজিটাল লেনদেন থেকে বঞ্চিত হবে।
এবিবি অর্থমন্ত্রীকে জানিয়েছে, বেশিরভাগ ক্রেডিট কার্ডভিত্তিক লেনদেন এবং ফি ও চার্জ ভ্যাটের আওতাভুক্ত। ফলে নিম্ন-আয়ের শ্রেণীর সম্ভাব্য ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকরা, যাদের ট্যাক্স অব্যাহতির বিধান রয়েছে, তারাও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্বে অবদান রাখছে।
নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে ট্যাক্সমুক্ত গ্রাহকদের আর কোনোভাবেই ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হবে না, ফলে সরকার রাজস্ব আয়ের সুযোগবঞ্চিত হবে।